দেশে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দামামা বেজে উঠছে। আগামী ৪ মে থেকে চার ধাপে দেশব্যাপী কমবেশি ৪৫০টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। একইভাবে পর্যায়ক্রমে হবে সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন। যেকোনো জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের জন্য যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য। দেশের বিদ্যমান আইনকাঠামো অনুযায়ী নির্বাচন হয় বা হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সব আলাপ-আলোচনা নির্বাচন সর্বস্ব হয়ে পড়েছে। আলোচনা নির্বাচন দিয়ে শুরু, নির্বাচনেই শেষ হয়ে যায়।
নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার আমাদের মনোজগৎ থেকে ‘নির্বাসনে’ চলে যায়। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন এলে একই ‘হইচই’ বৃত্তাকারে ফিরে আসে। এ কয় বছর নির্বাচিত পরিষদ চেয়ারম্যান বা মেয়রদের একধরনের তালুক বা জমিদারির মতো চলে। দেশে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন আইনে পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে—ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন কাঠামো, সাংগঠনিক কাঠামো, কর্মপদ্ধতি, কর্মচারী কাঠামো, অর্থায়ন, আন্তপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক– এ রকম অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু কোনো সংস্কার বা প্রতিকার নেই। বরং রয়েছে একধরনের সর্বগ্রাসী উদাসীনতা।
এখানে শুধু উপজেলা পরিষদ নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। ১৯৮১ থেকে ২০২৪-এর পর্যন্ত ৪৩ বছরের (মাঝখানে ২০ বছর বন্ধ ছিল) মধ্যে প্রায় ২৫ বছর উপজেলা পরিষদ কাজ করল। সম্পন্ন হলো পাঁচটি নির্বাচন। এই ২৫ বছরেও কি এই পরিষদ সাবালকত্ব অর্জনে সক্ষম হলো? সুদীর্ঘকাল ধরে নাবালকত্ব লালনের বহুল আলোচিত প্রধান কারণ হলো, ত্রুটিপূর্ণ আইন, ততোধিক উদাসীনভাবে আইনের প্রয়োগ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সাংগঠনিক কাঠামো, অপ্রতুল অর্থায়ন, প্রবল জনবল-সংকট এবং সবকিছুকে ছাড়িয়ে চরম প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। অন্যান্য বিষয় ঊহ্য রেখে আপাতত ‘প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা’র কিছু বিষয় তুলে আনা যায়, যার আশু সমাধান সম্ভব।
এ পরিষদ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কাজ করে না। পরিষদে ন্যস্ত সরকারি দপ্তরগুলো এবং ন্যস্ত কর্মকর্তারা ন্যস্ততার বিধি-বিধান অনুসরণ করেন না। দপ্তর ন্যস্ত হলেও দপ্তরগুলোর অর্থকড়ি পরিষদ তহবিলে হস্তান্তরিত হয় না। অথচ ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সেটা হতো। পরিষদের কোনো সচিব নেই, নেই পরিকল্পনা, অর্থ ও বাজেট কর্মকর্তা, যা এ ব্যবস্থা চালুর প্রথম ১০ বছর (এরশাদ আমলে) ছিল।
প্রশাসন, পরিকল্পনা ও অর্থবিষয়ক আরও অনেক বিষয় আছে। যেসবের ওপর বছরের পর বছর কোনো পর্যালোচনা, মূল্যায়ন না হওয়ায় প্রয়োজনীয় প্রতিকার নেই। যেমন এ পরিষদের জন্য নির্বাচিত কোনো সদস্য নেই, আছেন একজন চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান। দুজন ভাইস চেয়ারের কাজ কী বা পরিষদের নিজস্ব সদস্য ছাড়া দুজন ভাইস চেয়ারের প্রয়োজনটাই বা কি? চেয়ার ও ভাইস চেয়ারের পদগুলো সার্বক্ষণিক না খণ্ডকালীন। দেখা যায়, চেয়ারম্যানরা অনেকে ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং ঢাকাতেই বসবাস করেন। মাসের কোনো একদিন সুবিধামতো সময়ে কর্মস্থলে যান। চেয়ারম্যান যদি উপজেলা পরিষদের ‘প্রধান নির্বাহী’ হবেন, তাহলে তিনি লাগাতার কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারেন না।
রাজনৈতিক নেতাদের ‘রাজনৈতিক প্রশাসক’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা যায় না। এ উদ্যোগ ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সব মেয়রের জন্য প্রয়োজন। তাদের নির্বাহী হিসেবে সরকারি আইনকানুন বিশেষত পরিকল্পনা, অর্থ, অডিট, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বুঝতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসের ব্যবস্থাপনা, সময়, শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতি মেনে চলতে হবে। এগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ ও চর্চা প্রয়োজন।
উপজেলা পরিষদের বেশির ভাগ চেয়ারম্যান এলাকার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল, দাবি-দাওয়া আদায় ইত্যাদি কাজে তাঁরা অত্যন্ত পারদর্শী। কিন্তু একজন প্রধান নির্বাহী হিসেবে ২৪ থেকে ২৫টি সরকারি দপ্তরের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা এবং প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কর্মচারীর একটি নির্বাহী সংস্থা পরিচালনার অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রয়োজনীয় পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ নেই। এসব দপ্তরের সেবা-পরিষেবাপ্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। অনেকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সব নথি বা ফাইল তাঁদের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হোক সেটি চান; কিন্তু ধৈর্য ধরে ফাইল পড়া এবং ফাইলে সিদ্ধান্ত লেখায় সময় দিতে চান না।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তাঁদের পরিষদে ন্যস্ত কর্মকর্তাদের ‘এসিআর’ বা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লিখতে চান। কিন্তু আইন তাদের সেই অধিকার দেননি। আইনে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে কর্মকর্তাদের বার্ষিক কার্যক্রম (এপিআর) লিখতে বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে গত ২৫ বছরে কোনো চেয়ারম্যান কোনো এপিআর লেখেননি। সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। জেলা পর্যায় থেকে উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার), জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় পর্যায় থেকে পরিচালক (স্থানীয় সরকার) ও বিভাগীয় কমিশনার এবং জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কেউই বিষয়টি জানতে চাননি। এপিআর ছাড়া যথারীতি ন্যস্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের ‘রাজনৈতিক প্রশাসক’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা যায় না। এ উদ্যোগ ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সব মেয়রের জন্য প্রয়োজন। তাদের নির্বাহী হিসেবে সরকারি আইনকানুন বিশেষত পরিকল্পনা, অর্থ, অডিট, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বুঝতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসের ব্যবস্থাপনা, সময়, শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতি মেনে চলতে হবে। এগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ ও চর্চা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ব্যবস্থাপনাও একই শৃঙ্খলা দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেটাকে অফিস বা কার্যালয় বলেন, সেগুলো সেই অর্থ অফিস নয়, বড়জোর একটি আড্ডাখানামাত্র। কিন্তু উপজেলা পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কার্যালয়। একজন মন্ত্রী একটি বিশেষ বিষয়ের দপ্তর দেখেন। একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ২৪টি মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কর্মকর্তা নিয়ে কাজ করবেন। কিছুটা ‘ছোট আকৃতি’র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো। তাই নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষায় সফলকাম হয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারে বসা সম্ভব হলেও ভালোভাবে কাজ করা অনেক সাধ্য-সাধনার বিষয়।
কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব মোটেও নয়। সে জন্য যে খোলামন, শেখার মানসিকতা ও নির্বাচিত পদপদবির প্রতি যে প্রতিশ্রুতিশীলতা থাকা প্রয়োজন। পদমর্যাদা, প্রটোকল ও পদের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে তাদের যতটা সোচ্চার দেখা যায়, সে পদের দায়িত্ব নির্বাহের আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে আগ্রহ থাকে প্রায় শূন্যের কোটায়। এ অসংগতি ইতিবাচকভাবে দূর করার চেষ্টা না করা হলে উপজেলা একটি শক্তিশালী সুশাসন ও সেবাব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে না।
আর একটি গুরুতর কাঠামোগত বিপত্তির কথা বলে শেষ করি। উপজেলা পরিষদ একটি ‘জন নির্বাহী সংস্থা’ হিসেবে ঘোরতর দ্বন্দ্বমুখর একটি জলন্ত কড়াই। এখানে পাঁচটি দ্বন্দ্ব যুগপৎভাবে সক্রিয়। দ্বন্দ্বরত পক্ষগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ: চেয়ারম্যান ও এমপি, চেয়ারম্যান ও পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌরসভা মেয়র, পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও অন্যান্য ন্যস্ত ও অ-ন্যস্ত কর্মকর্তারা।
পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা যাকে ইউএনও বলা হয়, তাঁর দ্বৈতসত্তা। তিনি একাধারে কেন্দ্রীয় সরকারের রেগুলেটরি বিষয়ের স্থানীয় তদারকি কর্মকর্তা আবার উপজেলা পরিষদের ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা’। তাঁর আনুষ্ঠানিক দুজন এবং অনানুষ্ঠানিক একজন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আছেন।
আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণকারীর একজন ডেপুটি কমিশনার আর একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্য। কোনো বিশ্লেষণে না গিয়ে বলব এ ব্যবস্থা প্রশাসনের জন্য কতটুকু স্বাস্থ্যকর! একজন সরকারি কর্মকর্তার তিনজন নিয়ন্ত্রণকারী ও দুটি সত্তা থাকতে পারে না। এই সাধারণ বিষয়টি সরকার বোঝে না, তা আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিয়ে সমস্যাটির সমাধান করছেন না। উপজেলা পরিষদের সাতকাহন আরও অনেক বাকি।
এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ তথা একটি ব্যবস্থা হিসেবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সমস্যাগুলোও বুঝতে হবে।
তোফায়েল আহমেদ শিক্ষক, গবেষক ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ
tofailahmed.info