নতুন শিক্ষাক্রম ভালো কি মন্দ, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু দরকারি একটা আলাপ আলোচনায় আসেনি। সেটি হলো, নতুন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয়েছে কেবল মাধ্যমিক স্তরে।
প্রাথমিকে মূলত পুরোনো শিক্ষাক্রমই একটু অদলবদল করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে শিখন-শেখানো কার্যক্রম প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকও রচিত হয়েছে পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী।
নতুন শিক্ষাক্রমকে বলা হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতামূলক শিখনপদ্ধতি’। এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয়েছিল, তা প্রথম শ্রেণি থেকে কার্যকর হবে। সে অনুযায়ী প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়।
কিন্তু মাঝখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক শাখা নিজেদের মতো করে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক রচনার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাথমিক শাখা ও মাধ্যমিক শাখার বিরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে চালু করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণি পার হওয়ার পর মাধ্যমিকে কেমন করে নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত হবে, সেটিও একপর্যায়ে জটিলতা তৈরি করে।
এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকের পুরোনো শিক্ষাক্রমকে প্রায় অবিকৃত রেখে তাকে মাধ্যমিকের সঙ্গে সমন্বিত করার চেষ্টা চালানো হয়। তবে নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে তাকে আদতে মেলানো সম্ভব হয়নি। কারণ, অভিজ্ঞতামূলক শিখনপদ্ধতির শ্রেণি-কার্যক্রম সম্পূর্ণ আলাদা।
এমনকি পাঠ্যপুস্তকের উপস্থাপন ভঙ্গি ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নপদ্ধতি একেবারেই আগের মতো নয়। ফলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম গ্রহণ না করায় জটিলতা রয়ে যায়।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনপদ্ধতিতে শ্রেণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে চারটি ধাপ আবশ্যিকভাবে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে কোনো একটি ধারণা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের লিখতে বা বলতে সুযোগ দিতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষার্থীরা তাদের এই ধারণা লিখিত বা মৌখিকভাবে শ্রেণিতে সহপাঠীদের সামনে উপস্থাপন করবে। এ সময় অন্য শিক্ষার্থীরা একই বিষয়ে তাদের অভিমত প্রকাশ করবে। শ্রেণিকক্ষে দুটি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষক বুঝতে চেষ্টা করবেন, ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার কোনো পর্যায়ে আছে।
তৃতীয় ধাপে এসে শিক্ষক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধারণার সঙ্গে একে সমন্বিত করবেন। চতুর্থ ও শেষ ধাপে শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করবেন, শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছে কি না।
শ্রেণি-কার্যক্রমের এই পদ্ধতি নিয়ে ‘শিক্ষক সহায়িকা’য় বিস্তারিত আলোচনা আছে। মূল পাঠ্যপুস্তক রচনা করার আগে এবার শিখন-শেখানো পদ্ধতি নিয়ে ভাবা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ‘শিক্ষক সহায়িকা’ তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে পুরোনো শিক্ষাক্রমে পাঠ্যপুস্তক রচনার পর ‘শিক্ষক সহায়িকা’ বানানো হয়েছে। সেই সহায়িকাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের হাতে পৌঁছায়নি। তা ছাড়া এবার পাঠ্যপুস্তকের উপস্থাপনভঙ্গিও এমন করা হয়েছে, যাতে অভিজ্ঞতামূলক শিখনপদ্ধতির চারটি ধাপ অনুসরণ করা সহজ হয়।
পাঠ্যপুস্তক শিখন-শেখানো কার্যক্রমের একমাত্র উপকরণ নয়, তবে প্রধান উপকরণ। নতুন শিক্ষাক্রমের স্পষ্ট প্রতিফলন নতুন পাঠ্যপুস্তকে আছে। এখন প্রাথমিকের শ্রেণিগুলোতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা জরুরি।
নতুন শিক্ষাক্রমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এখানে একীভূত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিফলন নতুন পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন রকম বৈচিত্র্য দেখা যায়।
জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষাসহ সব ধরনের বৈচিত্র্যকে সমন্বিত করার কথা আগের শিক্ষাক্রমেও ছিল। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি নানা রকম প্রতিবন্ধিতা বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে শ্রেণিকক্ষে সমন্বিত পাঠদান করা সম্ভব, তার দিকনির্দেশনা নতুন শিক্ষাক্রমে আছে। ‘শিক্ষক সহায়িকা’তেও তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
এই শিক্ষাক্রমে ‘ক্রসকাটিং’ বলে আরেকটি ধারণা যোগ হয়েছে, যা আগে ছিল না। এক-একটি শ্রেণিতে ১০টি করে বিষয় আছে; যেগুলো আবার অনেক জায়গায় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এবার সেই সম্পর্কগুলো বিবেচনায় নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আগে প্রতিটি শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করে নেওয়া হয়েছে। তারপর সেই যোগ্যতার সঙ্গে একই শ্রেণির অন্য বিষয়ের যোগ্যতাগুলোর মিল বা সাদৃশ্য লক্ষ করে সেটিকে সমন্বিত করা হয়েছে।
মূল্যায়নপ্রক্রিয়াতেও আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় নম্বরকে মোটেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, বরং শিক্ষার্থী তার যোগ্যতা বা দক্ষতা কতটুকু অর্জন করেছে, সেটির মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়নের মাপকাঠিগুলো আগের মতো নয়। ফলে রেজাল্ট কার্ড বা মূল্যায়নপত্রও আগের মতো নেই। আগে নম্বর ও জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর অবস্থান বোঝা যেত।
এখন রেজাল্ট কার্ডে বিস্তারিত লেখা থাকবে শিক্ষার্থী শ্রেণিগত কোন যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করেছে। কোনো শিক্ষার্থী যোগ্যতার ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারে; তবে নতুন শ্রেণিতে একই যোগ্যতার উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের জন্য তাকে আগের শিখনঘাটতি পূরণ করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময়ে এটা বলা হয়নি, তা কেবল মাধ্যমিক শ্রেণির জন্য করা হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমের সুফল পাওয়ার জন্য প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন দরকার। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে রচিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে আসে ২০২৩ সালে।
এ বছর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে। আগামী বছর দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের বই পাবে।
পাঠ্যপুস্তক শিখন-শেখানো কার্যক্রমের একমাত্র উপকরণ নয়, তবে প্রধান উপকরণ। নতুন শিক্ষাক্রমের স্পষ্ট প্রতিফলন নতুন পাঠ্যপুস্তকে আছে। এখন প্রাথমিকের শ্রেণিগুলোতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা জরুরি।
একই সঙ্গে এই আলোকে নতুন করে প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক ও ‘শিক্ষক সহায়িকা’ প্রণয়ন করা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার মূল্যায়নপদ্ধতিতেও নতুন শিক্ষাক্রমের ধারণা যোগ করা। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থবহ পরিবর্তন আনার জন্য অভিজ্ঞতামূলক শিখনপদ্ধতির মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক