নির্দিষ্ট সময় পরপর আমেরিকার কি ভূত তাড়ানোর প্রয়োজন হয়? প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার ইতিহাসে কমবেশি ৮০ বছর পরপর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যার প্রভাব হয় বৈশ্বিক। প্রতি আট দশক পরপর যুক্তরাষ্ট্র একবার করে দেশের ভেতরে এমন অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যে তা থেকে উত্তরণের জন্য তাদের যুদ্ধ করতে হয়।
প্রথম সংকট: ১৭৮১
যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে। ১৭৭৬-১৭৮৩ সালের মধ্যে যে বিপ্লবী যুদ্ধ হয়েছিল, তা শুরুই হয়েছিল ১৩টি ঔপনিবেশকে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে জোর করে বের করে আনার প্রচেষ্টা থেকে। এই সংঘাতে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র ও উপনিবেশগুলোর ভূখণ্ডে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু করে তারা।
আমেরিকানদের পক্ষ নিয়ে ফ্রান্স এই সংঘাতে প্রবেশ করে। স্পেন, ডাচ প্রজাতন্ত্রও তাদের পক্ষ নেয়। ১৭৫৬-৬৩ সাত বছরের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে এবং ব্রিটিশ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আমেরিকানদের সঙ্গে ফ্রান্সসহ ইউরোপের শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ব্রিটেন তাদের বাহিনীতে ভাড়াটে জার্মান সেনা যুক্ত করে আমেরিকায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এ কারণে প্রুশিয়ার সঙ্গে ব্রিটেনের মৈত্রী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অটুট ছিল।
আমেরিকানরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। অনেকে ইংল্যান্ডের পক্ষ নেয় এবং রাজতন্ত্রের হয়ে লড়াই করে। উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা অথবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকা—এই দুই নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে তিক্ত বিভক্তি তৈরি হয়েছিল।
দ্বিতীয় সংকট, ১৮৬১
কমবেশি ৮০ বছর পর, দাস সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয় তাতে আমেরিকান সমাজে বিভক্তি চরমে পৌঁছে। উত্তরে যে আধুনিক কারখানাগুলো গড়ে উঠেছিল তারা দাসদের তুলনায় শ্রমিকদের ভালো মজুরি দিতে শুরু করে।
আর দক্ষিণে তখনো দাসেরা ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ। সেই সময়ের শিল্পোৎপাদনের প্রধান পণ্য তুলা ও চিনি উৎপাদনের মৌলিক চালিকাশক্তি তারা।
উন্নয়নের এই দুই মডেল পুরো দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও বিভক্তি তৈরি হয়েছিল। একটি অংশের কাছে মনে হয়েছিল, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা দাসপ্রথা থেকে মুক্ত হলে সেটা অর্থনৈতিক জন্য লাভজনক। অন্য অংশ মনে করল, কালো মানুষেরা দাসপ্রথা থেকে মুক্ত হলে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
এটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। সে সময়ে বিশ্বের পরাশক্তি ইংল্যান্ড ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭) দমনে এবং উপমহাদেশে তাদের ক্ষমতা সুদৃঢ় করার কাজে নিয়োজিত ছিল।
একই সময় তারা চীনে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধে (১৮৫৬-১৮৬০) জড়িয়ে পড়েছিল। তার কারণ হলো, চীনের কাছ থেকে আফিম ব্যবসায় আমেরিকা ও ফ্রান্স বড় ছাড় আদায় করে নিয়েছিল।
সর্বোপরি সেটা ছিল বৈশ্বিক সংঘাতময় একটা দশক। ইংল্যান্ড খুব ভুলভাবে যুক্তরাষ্ট্রে উত্তরের ইউনিয়নবাদীদের বিপক্ষে দক্ষিণের কনফেডারেশনপন্থীদের সমর্থন দিয়েছিল। ঘটনাচক্রে ১৮৬৫ সালে গিয়ে এই সংঘাতে উত্তরের ইউনিয়নবাদীরাই জয়ী হয়েছিল।
১৮৬১ সালটাই আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। কেননা, তখনো আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্রিটিশ সম্পৃক্ততা ছিল।
তৃতীয় সংকট, ১৯৪১
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে ১৯৪১ সালে আমেরিকা আবার শক্তভাবে সংকটের বৃত্তে আটকে যায়। ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
আমেরিকার মহত্তম কবি এজরা পাউন্ড ছিলেন একজন ফ্যাসিস্ট। যুদ্ধের সময়টাতে তিনি ইতালিতে বসে খুবই অদরকারিভাবে আমেরিকাবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যান। সম্ভবত চার্লস লিন্ডবার্গ ছিলেন সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় আমেরিকান। নাৎসিবাদী লিন্ডবার্গ যুক্তরাষ্ট্র কেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেল তা নিয়ে প্রচারণায় নেমেছিলেন।
অন্যদিকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের আন্দোলনও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। ইহুদি ও কালো মানুষদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণ নির্লজ্জভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
আফ্রিকান আমেরিকানরা তখন আর দাস নন, কিন্তু সাদা মানুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে তাদের সমমর্যাদা ও অধিকার ছিল না। ১৯২৯ সালের বিপর্যস্ত বাজার এবং মহামন্দার কারণে, বেকারত্বের হার রেকর্ড ২৫ শতাংশ পেরিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি গৃহযুদ্ধের চূড়ায় পৌঁছায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও বিভাজন দেখা দেয়। ইউরোপের সমস্যায় তাদের কি যুক্ত হওয়া উচিত এবং গ্রেট ব্রিটেনকে কি আরও একবার সমর্থন দেওয়া উচিত অথবা দূরে থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা নেওয়া উচিত।
পার্ল হারবারে আক্রমণ সেই অচলাবস্থা খুলে দেয়। ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিরা দৃশ্যপট থেকে অপসারিত হয়। ১৯৪৫ সালের পর যে শীতলযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেখানে সমাজতন্ত্রী আন্দোলন দমন ও খর্ব করার চেষ্টা করে যায় যুক্তরাষ্ট্র। নতুন গৃহযুদ্ধ এড়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মোট ৫০ বছর ব্যয় করে আমেরিকা। এ সময়পর্বে ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে তিক্ত ও সহিংস নাগরিক অধিকার আন্দোলন হয়।
চতুর্থ সংকট, ২০২১
৮০ বছরের সময়কাল যদি সঠিক হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে এখন চতুর্থ সংকট চলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলো আন্দোলন ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে এই সংকট আবর্তিত হচ্ছে। ৮০ বছর আগে তখনকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতো এখনকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গোঁড়া বাম ও ডানপন্থীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছেন।
আগের তিনটা সংকট যদি পথ দেখায় তাহলে একটা বেদনাদায়ক বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল দল ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এবারে ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়।
আগের মতো এবারও বৈশ্বিক সংঘাতের তীব্রতা বাড়ার শঙ্কা বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আড়াইটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে, হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলে এবং ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত হুতিদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতাও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন যেকোনো সময়ের জন্য একটা ভারসাম্যমূলক বিশ্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের ভেতরের উত্তেজনা কীভাবে যুদ্ধ উসকে দিচ্ছে, সেটা সহজেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। চরমভাবে বিভক্ত একটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে গেলে একটা সাধারণ ঐকমত্য দরকার হবে। সেটা কি চীনের সঙ্গে যুদ্ধ? ৮০ বছরের এই অপয়া তাড়াতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বের প্রজ্ঞা দরকার।
ফ্রান্সেসকো সিসি চীনের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে ইতালীয় পণ্ডিত
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত