শুরুটা করি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। সময়টা তখন ২০০৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ি। প্রথম বর্ষের পুরো সময়টা সাভারে মামার বাসায় থেকে হেমন্ত বাসে আসা-যাওয়া করে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরীক্ষা সামনে, হলে না উঠলে আর চলছে না। কয়েক দিন হাউস টিউটর আর হল প্রাধ্যক্ষের কাছে বৃথা ঘোরাফেরা চলল। শেষে সহপাঠীরা যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের শরণাপন্ন হলাম। তাঁরা রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে হলে উঠেছেন। তাঁদের পরামর্শ মেনে দূরসম্পর্কের এক রাজনৈতিক মামার কাছে দরবারে গিয়ে হাজির হলাম। তাঁর কল্যাণে হলে থাকার একটা ব্যবস্থা হলো।
পরদিনই বই-বাক্স-পেটরা নিয়ে হলে উঠে গেলাম। কয়েক দিন পরই নতুন মাস। বাড়ি থেকে মানি অর্ডারে মাসের খরচ এল। সন্ধ্যার মধ্যে ফেরত দেওয়ার কথা বলে মামা ধার চাইলেন। আমি সরল মনে দিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে, দিন, সপ্তাহ, পক্ষকাল পেরিয়ে গেল। কিন্তু ধারশোধের আর নামগন্ধ নেই। মাস শেষের কয়েক দিন তীব্র টানাটানি গেল। নতুন মাস এল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তত দিনে জেনে গেছি, রাজনৈতিক দাদা-মামাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক কক্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন। হলের ক্যানটিনে ফ্রি খাওয়া, চায়ের দোকান থেকে চা-সিগারেট খাওয়ার মতোই সেটাও স্বাভাবিক প্রথা।
দেড় যুগ আগের ঘটনা। তখন পোস্ট অফিসে মানি অর্ডার আর বুথ টেলিফোনে যোগাযোগের যুগ। এখন তো স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের যুগ। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সেই সংস্কৃতি খুব কি বদলেছে? তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। গত ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে একটানা আওয়ামী লীগ। ২১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কীর্তি নিয়ে ‘ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ তদন্ত কমিটি পর্যন্তই’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন ছেপেছে, তা পড়তে গিয়ে ঘুরেফিরে এই প্রশ্নই জাগতে শুরু করল।
প্রতিবেদন থেকে জানতে পারছি, করোনা মহামারির প্রকোপ কমে যাওয়ার পর ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও খুলে দেওয়া হয়। হলগুলোয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য কক্ষগুলোয় তালা মেরে দিয়ে আসন দখল করেন ছাত্রলীগের নেতারা। মারধর করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে বৈধ শিক্ষার্থীদের হলছাড়া করতে থাকেন নেতারা। অভিযোগ আছে, সেসব শূন্য আসনে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে ভাড়া দিতে শুরু করেন তাঁরা। মহামারি শেষে হল খুলে দেওয়ার পর গত ১৪-১৫ মাসে হল থেকে বিভিন্নভাবে ২৩ শিক্ষার্থীকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। আবার নেতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাঁদা দিতে না পারায় নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এলে আবাসিক শিক্ষক ও প্রাধ্যক্ষরা তাঁদের হলে ওঠার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এ সময় প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেছে ছাত্রলীগ।
গত ১৯ জানুয়ারি রাতে শাহ মখদুম হলে মারধরের শিকার হন ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম। তাঁর অভিযোগ হলো, যে কক্ষে তিনি থাকেন, সেখানে থাকতে হলে ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসানকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। আর এ তথ্য কাউকে প্রকাশ করলে, তাঁর লাশ ফেলে দেওয়া হবে আর পরিবারের লোকজন তা খুঁজেও পাবে না। সামিউলের মানিব্যাগে থাকা ৩ হাজার ৭৭৫ টাকা ছিনিয়ে নেন ছাত্রলীগ নেতা। বাড়িতে ফোন দিয়ে বাকি টাকা তৎক্ষণাৎ বিকাশে দিতে বলেন। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় সামিউলকে মারধর শুরু করেন তাজবিউল; তাঁর অনুসারীরা মেঝেয় ফেলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারা শুরু করেন।
এর আগে, গত বছরের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই নেতা তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল-আমিনের কাছ চাঁদা দাবি করে প্রত্যাশামাফিক টাকা না পাওয়ায় তাঁকে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর করেন। একপর্যায়ে তাঁর ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকা তুলে নেন।
শিক্ষার্থীদের মারধর, নির্যাতন, হল থেকে বের করে দেওয়া, তাঁদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি—এসব ঘটনা সুস্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। কিন্তু ছাত্রলীগের এসব চাঁদাবাজি ও মারধরের একটি ঘটনায়ও কেউ শাস্তি পেয়েছেন, এ রকম নজির নেই। ২০২১ ও ২০২২ সালে এ ধরনের ২৩টি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন নির্যাতিত ২৩ শিক্ষার্থী। এর বিপরীতে ১৩টি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ছয়টি কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনেরও শাস্তি হয়নি। অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন সংবাদও জানা যায়নি।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়–অধিভুক্ত কলেজের চিত্র কমবেশি একই। কোথাও কোনো প্রতিকার নেই। কেন নেই? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য নব্বইপরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্রের তিন দশকে ক্ষমতাসীন দলগুলো ছাত্র রাজনীতিকে কীভাবে দেখে, তার ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন। ঐতিহ্যগতভাবেই এই ভূখণ্ডের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মূল চালিকা শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজপড়ুয়ারা। সরকার গঠনের পর ক্ষমতাসীন দলগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, সেই সূত্র ধরেই শিক্ষার্থীদের বড় অংশটাই এস্টাব্লিশমেন্টবিরোধী হয়ে পড়ে। সে কারণে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থাকলে তাদের মাধ্যমে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠাটা স্বাভাবিক।
৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ ও ২০০৭–এর দৃষ্টান্ত। এ ভয় থেকেই মূলত ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সব ধরনের বিরোধী মত যেমন দমন করা হয়, ঠিক তেমন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়ের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী দমনের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবেই ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করা হয়। ফলে শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনাগুলো অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না।
ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে আরেকটি যে মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয় তা হলো, ছাত্রনেতাদের বয়স। সেশনজট না থাকায় এখন শিক্ষার্থীরা ২৩-২৪ বছরেই উচ্চশিক্ষার পাঠ শেষ করতে পারেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যাঁরা আসছেন, তাঁদের বয়স ৩০-৩২ থেকে ৩৬-৩৮। তাঁরা কেউই নিয়মিত শিক্ষার্থী নন। তাঁদের ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশল হলো, বিভিন্ন সান্ধ্য কোর্স ও প্রোগ্রামে ভর্তি থাকা কিংবা বছরের পর বছর পরীক্ষা না দেওয়া। নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়ায় হলপর্যায়েও যাঁরা নেতা হচ্ছেন, তাঁদের গড় বয়সও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের গড় বয়সের চেয়ে অনেকটাই বেশি। যে বয়সে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থী চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো কর্মসংস্থানে ঢুকছেন, সে বয়সে ছাত্রনেতারা ছাত্ররাজনীতি করছেন। কিন্তু তাঁদের আয়ের উৎস কী?
নিয়মিত ছাত্রত্ব অবসান হওয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে সন্তানদের জীবনযাপনের খরচ জোগানোর সামর্থ্য কয়টা পরিবারের আছে? চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, মারামারি, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন-জখম, ক্যানটিনে ফাও খাওয়া—ছাত্রলীগ নিয়ে এমন সব নেতিবাচক খবর যে সংবাদমাধ্যমের পাতা ভরে থাকে, তার কারণ কী?
অপ্রীতিকর সত্য হলেও ছাত্ররাজনীতির এটা একটা রূঢ় বাস্তবতা। দলীয় লেজুড়বৃত্তি আর বিরোধী মত ও সাধারণ শিক্ষার্থী দমনে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার ছাত্ররাজনীতি যখন টিকিয়ে রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উচিত ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব নেওয়া। তাঁদের পকেট থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়মিত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা। অন্তত তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদাবাজির হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। ছাত্রদলের মতো সংগঠনের ক্ষেত্রেও সেটা করা জরুরি।
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী