সব কোম্পানিকে কেন বাধ্যতামূলক নিরীক্ষা করাতে হবে

কেন ছোট-বড় সব কোম্পানিকেই বাধ্যতামূলক নিরীক্ষা করাতে হয়?
এর দুটি সহজ উত্তর হতে পারে।

এক, কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী নিরীক্ষা করাতে হয় এবং প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরীক্ষার কপি যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) জমা দিতে হয়।

দুই, আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী নিরীক্ষার কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় সংযুক্ত করতে হয়।

আইনগত দিকের বাইরে বড় অর্থে যদি বলা হয়, তাহলে নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, কোম্পানির সঙ্গে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল (স্টেকহোল্ডার) জড়িত, তাঁরা যাতে আর্থিক বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য নিরীক্ষা করানো হয়।

যেমন তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনেকেই শেয়ারহোল্ডার থাকেন, যাঁরা দৈনন্দিন কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে জড়িত নন।

আবার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা পাওনাদার যখন ঋণ দেন অথবা ধারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন, তখন তাঁরাও এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন। তাই তাঁদের জন্যও নিরীক্ষা করাতে হয়।

মূলত ওপরের কয়েকটি কারণে কোম্পানি নিরীক্ষা করার কথা চলে আসে।

প্রথমে সব কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের প্রয়োজন আছে কি না, তা বিবেচনা করা দরকার। তারপর আইনের বিষয়টা আসবে।

কারণ, মানুষের দরকারেই আইন সময়–সময় যুগোপযোগী করে প্রণয়ন করা হয়।

আরও পড়ুন

কেন সব কোম্পানির জন্য নিরীক্ষা অযৌক্তিক

তালিকাভুক্ত এবং বড় আকারের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা যেহেতু কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকেন না, তাই তাঁদের জন্য কোনো আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্যতম উপায় হলো নিরীক্ষা প্রতিবেদন।

কিন্তু যে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার নিজের পরিবার বা পরিচিত কয়েকজন মিলে গঠন করেছেন, তাঁদের জন্য কেন নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক হবে?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যরা মিলে কোম্পানি গঠন করেন এবং তাঁরা কোম্পানির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

এর ফলে তাঁরা সব আর্থিক ও অনার্থিক বিষয় অবগত থাকেন।

আরেকটা বড় বিষয় হলো, এমন অনেক কোম্পানিরই দেখা যাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেই।

নিজের দেওয়া মূলধন বা আপনজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাই তাঁদের নিরীক্ষার দরকার না–ও হতে পারে।

কোম্পানি আইন ও আয়কর আইনে যে নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা অধিকাংশ কোম্পানিই পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আরও পড়ুন

এখানে সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, রিটার্ন দাখিলের সময় কয়েকবার বৃদ্ধি করার পরও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার কোম্পানি রিটার্ন দাখিল করেছে।

অথচ বাংলাদেশে আড়াই লাখের ওপর কোম্পানি রয়েছে এবং এর মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ৪০ হাজারের মতো কোম্পানি রিটার্ন দাখিল করে।

এ ছাড়া যে ৪০ হাজার কোম্পানি রিটার্ন দাখিল করেছে, বিগত বছরগুলোয় তার মধ্যে কতগুলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দ্বারা নিরীক্ষিত হয়েছে? অনেক ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কথা অতীতে শোনা গেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু করেছে। এখন এই ৪০ হাজারের মধ্যে কতগুলো আইসিএবি নিরীক্ষা করেছে, তা যদি তারা প্রকাশ করে, তাহলে প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, বাকি প্রায় দুই লাখ কোম্পানি কেন কোম্পানি আইন ও আয়কর আইন মেনে নিরীক্ষা ও রিটার্ন দাখিল করে না?

এর একমাত্র উত্তর হতে পারে, এই বিশাল কোম্পানিগুলোর আকার অনেকটাই ছোট এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা নাজুক।

এ জন্য আইন থাকার পরও কোম্পানির আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তারা নিয়ম পালন করতে পারছে না।

যেকোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শুরু করার পর প্রথম কয়েক বছর বেশ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আয় কম হয়, কিন্তু খরচ হতেই থাকে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তারা নিজেদের কাছ থেকে এবং কিছু সময় পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে কোম্পানি টিকিয়ে রাখেন।

এমন অবস্থায় যদি বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো কোম্পানি টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাবে, নয়তো বিদ্যমান আইন অনুসরণ করবে না। যেটা হয়ে আসছে।

তবে এ ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনে একটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যদি কোম্পানি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয় বা ঋণ নেওয়া থাকে এবং কোনো শেয়ারহোল্ডার যদি নিরীক্ষা করাতে চায়, তাহলে করাতে পারবে। কিন্তু কোম্পানি আইন ও আয়কর আইন এ বিষয়কে চাপিয়ে দেবে না। উদ্যোক্তারা স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে আসেন। শুরু করার আগেই তাঁদের নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে ফেলে জর্জরিত করানো হচ্ছে।

সমাধান কী

ছোট কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলক অযৌক্তিক নিরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, যদি নিরীক্ষা না করায়, তাহলে এসব কোম্পানির আয়কর রিটার্ন দাখিলের পর কিসের ভিত্তিতে আয়কর নির্ধারণ হবে?

এর সহজ উত্তর হলো, আয়কর আইন ২০২৩–এর ৭৩ ধারায় বলা আছে, কোনো অংশীদারি ব্যবসা, ট্রাস্ট, ব্যক্তিসংঘ, ফাউন্ডেশন, সমিতি ও সমবায় সমিতির মোট প্রাপ্তি যদি অনধিক পাঁচ কোটি টাকা হয়, তাহলে নিরীক্ষাকৃত আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে না।

ঠিক একই রকম যেসব কোম্পানির বার্ষিক আয় এই সীমা পর্যন্ত থাকবে, তাদের নিরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ায় ২০২৪ সালের হিসাবমতে মোট ২৬ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, যার মধ্যে প্রায় ১২ লাখ হলো কোম্পানি। অথচ অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। অর্থাৎ জনসংখ্যার তুলনায় কোম্পানির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ! এর মধ্যে বেশির ভাগই হলো ছোট কোম্পানি।

এই ছোট কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক বিবরণী ও নিরীক্ষার বিষয়ে নমনীয়তা রয়েছে।

কোনো কোম্পানির বার্ষিক আয় ৫০ মিলিয়ন ডলার অথবা মোট সম্পদ ২৫ মিলিয়ন ডলার অথবা ১০০ জন কর্মচারী; এর মধ্যে যেকোনো দুটি পূরণ হলে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে নিরীক্ষা করাতে হয়।

বাকি কোম্পানির আর্থিক বিবরণী ও নিরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

এখন তাহলে তারা কীভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে

বাংলাদেশে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে যাঁরা এক মালিকানা ব্যবসা করেন এবং যেসব অংশীদারি ব্যবসা, ট্রাস্ট, ব্যক্তিসংঘ, ফাউন্ডেশন, সমিতি ও সমবায় সমিতির মোট প্রাপ্তি পাঁচ কোটি টাকার নিচে, তাঁরা আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার জন্য যেভাবে লাভ-ক্ষতি হিসাব এবং স্থিতিপত্র প্রস্তুত করেন, ঠিক একই রকম অস্ট্রেলিয়ান ছোট কোম্পানিগুলোও তৈরি করে থাকে।

তবে এ ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনে একটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যদি কোম্পানি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয় বা ঋণ নেওয়া থাকে এবং কোনো শেয়ারহোল্ডার যদি নিরীক্ষা করাতে চায়, তাহলে করাতে পারবে।

কিন্তু কোম্পানি আইন ও আয়কর আইন এ বিষয়কে চাপিয়ে দেবে না।

উদ্যোক্তারা স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে আসেন। শুরু করার আগেই তাঁদের নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে ফেলে জর্জরিত করানো হচ্ছে।

প্রতি মাসে ভ্যাট রিটার্ন, আয়করের একাধিক রিটার্ন—এগুলো চাপিয়ে দিয়ে একদিকে অর্থের, অন্যদিকে মূল্যবান সময়ের অপচয় হচ্ছে। শুরু করতে গিয়েই হতাশ হয়ে যান এবং এত নিয়মপালনের বিষয় জানার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

ব্যবসা করার সুযোগ আগে দেওয়া দরকার। তারপর যখন আর্থিক অবস্থা ভালো হবে, তখন নিয়ম পালন করা হচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করলেই সুফল পাওয়া যাবে।

জসীম উদ্দিন রাসেল অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
ju_rasel@yahoo.com