২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সুষ্ঠু ভোটের অক্ষমতা থেকেই কি দেখানোর এই আয়োজন

বছরের শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের মুখে শোনা গেল, নির্বাচন শুধু সুষ্ঠু হলে চলবে না; নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন, ‘ইনকারেক্ট পারসেপশন (ভুল ধারণা) হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের দায় জনগণ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রতি। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে খাটো করে দেখা যাবে না, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কমিউনিটির অংশ।’ এর এক দিন পর কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ হয়ে যাবে। 

মনে হচ্ছে, আমাদের নির্বাচন কমিশন হঠাৎ যেন জেগে উঠে বুঝতে পেরেছে যে নির্বাচন নামক একটু অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অনুশীলনের যথাযথ ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তাদের কাঁধে এসে পড়েছে।

অথচ গত ৬ ডিসেম্বর কমিশনারদের একজন মো. আলমগীর বলেছেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে কমিশনের ওপর বিদেশিদের কোনো চাপ নেই এবং চাপ দেওয়ার কোনো অধিকারও তাঁদের নেই।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হচ্ছে, গত সপ্তাহ চারেক সময়ে কী ঘটেছে এবং কী তাঁরা আশা করেছিলেন যে নিরুদ্বেগ ভাব ছেড়ে এখন তাঁরা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন?

অতিরঞ্জন, আংশিক সত্য কিংবা তথ্য বিকৃতির সঙ্গে রাজনীতির একধরনের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। তাঁদের কথায় সব সময় ধারাবাহিকতাও থাকে না। আজ যা বলেন, কাল তার উল্টোটাও বলতে পারেন।

শাহজাহান ওমরের কথাই ধরুন, জেলে যাওয়ার আগে তিনি গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা হিসেবে পিটার হাসকে ‘দেবদূত’ বলতেও দ্বিধা করেননি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন সূত্রে তাঁর কথার সুর পুরোই বদলে গেছে।

তবে তিনিও বলছেন, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট না দেখাতে পারলে স্যাংশন আসবে। একই রকম সুর এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কণ্ঠে শোনা গেলে তো সেটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্যে তাই কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

আরও পড়ুন

এ ক্ষেত্রে সবার আগে জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হলে চলবে না, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে’ কথাগুলো নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের হাতের মুঠোয় চলে যাওয়ার পর কেন বলা হচ্ছে?

৩০০ আসনের মধ্যে কমিশন কি ৩০টি আসনও দেখাতে পারে, যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে? 

প্রায় প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের মুখে আমরা শুনছি, ‘এখানে ঈগল মার্কাই নৌকা মার্কা’, কিংবা ‘এখানে ট্রাক মার্কাই নৌকা মার্কা’।

এমনকি বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর লাঙ্গল প্রতীকের পোস্টারেও লেখা ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’। অর্থাৎ ভোট যাঁকেই দেওয়া হোক, তা হবে নৌকা প্রতীকের।

ফলে আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদ শুধু নিশ্চিত না, দেখা যাবে শেষ বিচারে প্রায় শতভাগ আসনই তাদের। এটি অনুমান নয়, এটি নিশ্চিত। এর অন্যথা হওয়ার পথ নেই।

আরও পড়ুন

এই ‘পূর্বনির্ধারিত ফলাফল’কে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ হিসেবে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ দেওয়ার জন্য সিইসির যে ব্যাকুলতা, তাকে অসহায়ত্ব বলে হয়তো তাঁর প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখানো যেত, কিন্তু তিনি যখন নির্দিষ্ট করে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ইনকারেক্ট পারসেপশন’ হতে দেওয়া যাবে না, তখন সেখানে আর যা–ই হোক সৎ উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটে না।

যে নির্বাচন ইতিমধ্যেই একটি দলের হাতের মুঠোয়, সেই নির্বাচনে গোষ্ঠীগত বা গোত্রগত দখলদারির লড়াইয়ে সাধারণ ভোটারদের আর কি স্বার্থ বা আগ্রহের অবকাশ থাকে? এখন যেসব অন্তর্দলীয় রক্তারক্তি ঘটছে ও সহিংসতা হচ্ছে, তার দায় প্রধানত সরকারের হলেও নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই দায়মুক্ত হয় না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘আমি’ আর ‘ডামি’র মধ্যে সাজানো ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বন্ধে কমিশন কী করতে পারত, তার কিছুটা উত্তর আইনের মধ্যেই রয়েছে। মনোনয়নপত্রের বাছাইপর্বেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দলীয় গঠনতন্ত্রের বিধি ভেঙে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় দায়িত্বে থাকা সদস্যদের প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে হাতিয়ার করার কারণে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানো হয়তো খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই যেহেতু ভোটারদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে না, সেহেতু একে বিশ্বাসযোগ্য করার আর কোনো অবকাশ নেই। কমিশন বরং এখন ভাবতে পারে যে কীভাবে তারা ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে পারে।

এতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত ২৮ সংসদ সদস্য এখন নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ঈগল বা ট্রাকের মতো প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন।

সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংবিধানের ৭০ ধারায় যে সংসদ সদস্য তাঁর পদ হারাতেন, সেই সংসদ সদস্য এখন দলের প্রার্থী ও প্রতীকের বিরুদ্ধে মানুষের ভোট চাইছেন। কমিশন কীভাবে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুমোদন করতে পারে?

দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ ছাড়া দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থিতা বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়াই যে যৌক্তিক হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কমিশন একটু কঠোর হলে ক্ষমতাসীন দল এভাবে নির্বাচনকে নিজেদের ইচ্ছেমতো সাজানোর সুযোগ পেত না।

এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও কমিশন অন্তত নির্বাচনের নামে জোট শরিকদের আসন ভাগাভাগির অনুশীলনে সহযোগীর ভূমিকা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারত।

আমাদের নির্বাচন কমিশন আইনগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কিছু ক্ষমতার অধিকারী। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইনে কমিশন এসব ক্ষমতা পেয়েছে, যার ভিত্তিতে তারা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয় এবং তা বাতিলও করতে পারে।

আরও পড়ুন

এ আইনে প্রতিটি দলের অনুদান নেওয়া, অঙ্গসংগঠন রাখতে পারা না পারার মতো বিষয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এ আইনের ৯-এর খ অনুসারে দলের মনোনীত প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দ পান, সেহেতু দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও কমিশনের ভূমিকা গ্রহণের অবকাশ আছে। স্পষ্টতই কমিশন সে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে।

রাজনৈতিক দল বিধি মেনে চলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করার প্রশ্নে কমিশন যে আগ্রহী নয়, তা এর আগেও দেখা গেছে। এ আইনে বিদেশিদের কাছ থেকে অনুদান বা উপহার নেওয়া নিষিদ্ধ হলেও কোভিডের সময় চীন সরকারের চিকিৎসাসামগ্রী উপহার হিসেবে গ্রহণ করার কারণে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে কমিশন ব্যাখ্যা চেয়েছে বলেও শোনা যায়নি। 

‘নৌকায় ভোট দিলেও নৌকা, ঈগলে ভোট দিলেও নৌকা, আমরা সবাই নৌকা’ স্বীকারোক্তিটি বহুল নিন্দিত সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের মুখে (ভিডিওতে) শোনা।

এ রকম সাজানো আয়োজন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে বলে অন্তিমমুহূর্তে সিইসি ও সহযোগী কমিশনারদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা এখন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। প্রার্থিতা বাতিল, আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য মামলা কিংবা পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য দু-একজনকে বদলি, সবাই এখন এগুলো লোকদেখানো বলেই বলছেন।

ভোটের দিন পর্যন্ত এগুলো হয়তো আরও বাড়বে। কমিশন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছর সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যবস্থাও সম্পন্ন করে ফেলেছে।

চীন, রাশিয়া, ভারতসহ ১১টি দেশ থেকে বিশেষভাবে আমন্ত্রিতসহ মোট ৮০ জন পর্যবেক্ষক আসছেন। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন ভয় দেখানো থেকে শুরু করে নানা রকম উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়েছে। 

রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে হাতিয়ার করার কারণে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানো হয়তো খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই যেহেতু ভোটারদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে না, সেহেতু একে বিশ্বাসযোগ্য করার আর কোনো অবকাশ নেই। কমিশন বরং এখন ভাবতে পারে যে কীভাবে তারা ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে পারে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক