মো. জামাল আর আঞ্জুয়ারা দম্পতির এই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। দুজনেই সুদর্শন। আঞ্জুর চোখে একটুখানি পুষ্টিহীনতার রেশ যে নেই, তা বলব না। কিন্তু চোখ দুটো মায়াভরা। জামাল তো রীতিমতো কেতাদুরস্ত। চোখে হালকা সানগ্লাস।
আঞ্জুয়ারার গায়ে নীল জামা, জামালের টি-শার্টটা শর্ষে হলুদ। মাথার ওপরে ঢেউটিনটাও বিশেষ রকমের। ঢেউগুলো গোল গোল নয়, একটুখানি চৌকো ধরনের। লক্ষ করার মতো হলো পেছনের খাটটা। দেখে মনে হচ্ছে, ভালো কাঠের কারুকাজ। অবশ্য হালকা কোনো কৃত্রিম কাঠসদৃশ জিনিস দিয়ে বানানো হতে পারে।
আঞ্জুয়ারার বয়স ৩০। তাঁদের দুই ছেলে-মেয়ে। বড়টা ছেলে, আট বছর, নাম আরিফ, পড়ে ক্লাস থ্রিতে। ছোটটা মেয়ে, নাম জয়া, বয়স সাত, পড়ে ক্লাস টুয়ে। তারা থাকে দাদা-দাদির কাছে, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামে। পূজার ছুটিতে এসেছে মা-বাবার কাছে। মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে।
এখন আরিফ ও জয়া বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে মায়ের নিস্পন্দ দেহ। মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন করছেন পোশাকশ্রমিকেরা। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। ৮ নভেম্বর ২০২৩ সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন আঞ্জুয়ারা।
শ্রমিকেরা বলছেন, তাঁর গায়ে গুলি লেগেছিল, কেউ বলছেন লেগেছিল কাঁদানে গ্যাসের শেল। পুলিশ বলছে, শরীরে গুলির চিহ্ন নেই, হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন আঞ্জু।
সত্য এ-ই যে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শ্রমিকেরা, সেইখানে, পথে, আন্দোলনস্থলে আঘাত পেয়েছেন আঞ্জুয়ারা, আর তিনি মারা গেছেন। তিনি আর কোনো দিন জাগবেন না। জড়িয়ে ধরবেন না ছেলে আরিফকে, মেয়ে জয়াকে। তাঁর স্বামী জামাল আর কোনো দিনও আঞ্জুকে পাশে নিয়ে সেলফি তুলতে পারবেন না।
২
আমাদের পোশাককর্মীরা, আমাদের স্বল্প আয়ের মানুষেরা কীভাবে দিন গুজরান করেন, আমরা কি সেসবের খোঁজ নিই! আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িতে, আমাদের অফিসে, ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথে যে নিরাপত্তারক্ষীরা কাজ করেন, তাঁদের বেতন কত, আমরা কি একবার জিজ্ঞেস করে দেখেছি? যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অফিসে-আদালতে বাথরুম পরিষ্কার করেন, তাঁদের জিগ্যেস করে দেখেছি কি কত মাহিনা পান?
আমাদের বাড়ির গৃহকর্মীকে আমরা কত বেতন দিই, তাঁদের বছরে বা সপ্তাহে কদিন ছুটি, কত ঘণ্টা তাঁদের প্রতিদিনের ডিউটি, কোনো দিন কি খোঁজ নিয়ে দেখেছি! তাঁদের অনেকেরই বেতন হাজার আটেক টাকা, ওভারটাইম করে আরও চার–পাঁচ হাজার টাকা তাঁরা আয় করেন। বেসরকারি স্কুলশিক্ষকেরা ৫ হাজার টাকাও পান, ১৮ হাজারও পান। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকেরা ১৮–২০ হাজার থেকে শুরু করে মধ্য পর্যায়ে ২৫ হাজার টাকার মতন পান গড়ে।
আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ! রোজ জিনিসপাতির দাম বাড়ছে, জিরার কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা।
কী বলব, বুঝি না। রাতারাতি ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায়। পরে দেখা যায়, কোম্পানির কোনো ঠিকানা নেই। ব্যাংক লুট, টাকা পাচার, মেগা প্রকল্পের মেগা লুট বন্ধ করে সেফটিনেট শক্তিশালী করা হলে বৈষম্য হয়তো কমত। অর্থাৎ আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতি বন্ধ। অর্থাৎ করের আওতায় আনা বড়লোকদের।
নেটফ্লিক্সে একটা ডকুমেন্টারি সিরিজ আছে। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শিশুদের হাল নিয়ে। ‘টেলস বাই লাইট’। এই সিরিজ দেখতে আরম্ভ করে দুঃখে-কষ্টে-অপমানে-বিবেকের দংশনে আমি আর পুরোটা শেষ করতে পারিনি। ঢাকার শিশুরা কাজ করছে বেলুন বানানোর কারখানায়। অ্যালুমিনিয়ামের বাটি, গ্লাস বানানোর কারখানায়। খালি হাত দিয়ে গরম অ্যালুমিনিয়াম ঘুরন্ত চাকায় ধরে ধরে তারা তৈজস বানাচ্ছে। তারা চলে যাচ্ছে শহরের বর্জ্যগুলো ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয় যে আস্তাকুঁড়ে, সেখানে। সেই ময়লার পাহাড়ে উঠে তারা প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি কুড়াচ্ছে।
এই দেশে এত বৈষম্য কেন? বছর কয়েক আগে, ২০১৯ সালে আমি আমাদের গ্রামের বাড়ি, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে গিয়ে জড়ো হওয়া শিশুদের চোখে-মুখে দেখেছিলাম অপুষ্টির স্পষ্ট ছাপ। তখনো বলেছিলাম, এখনো বলছি, আমাদের স্কুলগুলোয় মিড-ডে মিল চালু করুন। গরম খিচুড়ি-ডিম দুপুরে শিক্ষার্থীদের খেতে দিন। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের করুণ চাহনি সহ্য করতে পারি না।
আপনারা জানেন, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ফুটবল চ্যাম্পিয়ন গ্রাম কলসিন্দুরের সঙ্গে প্রথম আলোর সখ্য আছে। ওই গ্রাম জাতীয় নারী ফুটবল দলের অনেক খেলোয়াড়কেই তৈরি করেছে। গত বছর ওই স্কুলে গিয়েছিলাম কিশোর আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে। এখন যারা প্রাথমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে, ফুটবল খেলে, তাদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে বিচলিত না হয়ে পারি না। বাচ্চারা খেলতে আসে, অনেকেই আসে আধা পেটে।
কিশোর আলোর পক্ষ থেকে ৩৫ জন শিশু-কিশোর খেলোয়াড়কে আমরা মাসে সামান্য বৃত্তি পাঠাতে শুরু করি। এক বছর পর, নিয়ম করতে চাইলাম, যারা ফুটবল খেলে না, তাদের বৃত্তি বন্ধ করে দেব। একটার পর একটা ফোন আসতে শুরু করল। আমরা তো খেলি, কেন বন্ধ করবেন। খুব সামান্য টাকা, ৫০০, ৭০০, ১০০০—এটা ওদের জন্য অনেক। আমি বলি, আচ্ছা, বন্ধ কোরো না।
আমার নীরব-সাহায্যকারীদের কাছে ফোন করি, ভাই, চাঁদা দেন; ওরা তো আসলে এটা দিয়ে এক বেলা একটুখানি হয়তো পেটপুরে খাবে। ফরিদুর রেজা সাগর ভাই, বাদল সৈয়দ, শামসুল আলম নাদিম, পিপলু খানরা অকাতরে আমার ডাকে সাড়া দেন। আগামী এক বছর ক্রীড়াশিক্ষকসহ কলসিন্দুুরের শিশু-কিশোর খেলোয়াড়দের মোট ৩৮ জন বৃত্তি পাবেন। কিন্তু আমি জানি, এ কত সামান্য। আর গ্রাম তো মাত্র একটা নয়। ৬৮ হাজার!
৩.
অথচ কোটিপতি উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে।
ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট। সেলিম রায়হান প্রথম আলোয় ৬ নভেম্বর লিখেছেন: ‘দুই দশক ধরে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বৈষম্য সূচকে বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, আয়ের জিনি সহগ (যা আয়বৈষম্যের একটি জনপ্রিয় পরিমাপ) ২০০০ সালে শূন্য দশমিক ৪৫০ থেকে ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯-তে উন্নীত হয়েছে। সম্পদের বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ।
অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ বাংলাদেশি জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।’
৪.
পোশাকশিল্পকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। কিন্তু গত কয়েক দিনে ডলারের দামই তো বেড়ে গেছে অনেক। আমার চোখের সামনেই তো কয়েক মাসে ডলারের দাম বেড়েছে তিন ভাগের এক ভাগ।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা বলছেন, যে হারে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা কার্যকর করাই অনেক কারখানার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।
কী বলব, বুঝি না। রাতারাতি ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায়। পরে দেখা যায়, কোম্পানির কোনো ঠিকানা নেই। ব্যাংক লুট, টাকা পাচার, মেগা প্রকল্পের মেগা লুট বন্ধ করে সেফটিনেট শক্তিশালী করা হলে বৈষম্য হয়তো কমত। অর্থাৎ আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতি বন্ধ। অর্থাৎ করের আওতায় আনা বড়লোকদের।
সমস্যা হলো, লুটেরা ধনিক, দুর্বৃত্ত ধনিক, ঋণখেলাপি ধনিক, দুর্নীতিবাজ ধনিক, চাঁদাবাজ ধনিক, মাদক ব্যবসায়ী, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্রাটেরা তো কর দেবেনই না, উল্টো টাকা পাচার করবেন বিদেশে। তাঁদের আছে প্রাইভেট জেট। তাঁরা এক রাতে বিদেশের হোটেলের ভাড়া গোনেন কোটি টাকা।
আর উল্টো দিকে! ২০ হাজার টাকা বেতনের স্কুলশিক্ষক কী করে মাস চালান, আমি জানি না। ১২ হাজার টাকা আয়ের নিরাপত্তারক্ষী কীভাবে সংসার চালান, আমার ধারণা নেই।
মা-হারা আরিফ আর জয়া, তোমাদের জন্য এই অক্ষম লেখকের একটুখানি দীর্ঘশ্বাস!
আমি জানি, তোমরা আমাদের ক্ষমা করতে পারবে না। আমরা সেই রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণি, যে রাষ্ট্র পেটপুরে খাওয়ার মতো মজুরি দিতে পারে না, কিন্তু কাঁদানে গ্যাসের শেল কিনতে বড় বাজেট তাকে ব্যয় করতে হয়।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক