গত ২৮ জুলাই মালদ্বীপ নিয়ে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মালদ্বীপ ঘিরে মহাসমর’। এ রকম শিরোনামের পেছনে কারণ ছিল, দেশটির নির্বাচন ঘিরে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র আগ্রহ।
প্রথম আলোর উল্লিখিত সেই ‘মহাসমর’ এখন চূড়ান্ত লগ্নে এসে হাজির হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে চীন ও ভারত সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত কোনো প্রার্থী ৫০ ভাগের বেশি ভোট পাননি। ফলে ভোট গড়িয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ৩০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফার সেই ভোট হবে। তবে ইতিমধ্যে দ্বীপরাষ্ট্রটির ওই দ্বিতীয় দফা নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে আরেক দফা।
প্রথম রাউন্ডের ফল
ভোটার সংখ্যার হিসাবে মালদ্বীপের নির্বাচনকে বাংলাদেশের যেকোনো একটা সংসদীয় আসনের চেয়ে ছোট আয়োজন বলা যায়। মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ এই নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বিরোধী দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের (পিএনএস) প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৪৬ ভাগ। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পেয়েছেন ৩৯ ভাগ ভোট। নির্বাচনে আরও ছয়জন প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে বাকি ১৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন। প্রথম দফার এই ফল থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত পিএনএসের মোহাম্মদ মুইজজু ও এমডিপির সলিহের মধ্যে। কিন্তু যে ছয়জন তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি, দ্বিতীয় দফা ভোটে তাঁদের ভোটাররা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।
মুইজজু কেন বেশি ভোট পেলেন
মালদ্বীপের চলতি নির্বাচনের মূল আকর্ষণ তৈরি হয় প্রার্থী বাছাইকালে। বিরোধী দল থেকে এই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনের। তিনি প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপের (পিপিএম) নেতা। আর সরকারি দল এমডিপি থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি মজলিশ নামে পরিচিত সর্বশেষ পার্লামেন্টের স্পিকার।
কিন্তু আদালতের দণ্ডের কারণে আবদুল্লাহ ইয়ামিন যেমন প্রার্থী হতে পারেননি, তেমনি এমডিপি থেকে নাশিদকে প্রার্থী হতে দেননি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহ। এর ফল হয়েছে দুটি। নাশিদ এমডিপি ছেড়ে দিয়েছেন। আর বিরোধী পক্ষ ইয়ামিনের বিকল্প হিসেবে মুইজজুকে প্রার্থী করে। মুইজজু প্রার্থী হয়েছেন দুটি বিরোধী দলের জোট প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স থেকে। এই জোটে আছে দুটি বিরোধী দল—পিপিএম এবং পিএনসি। এর মধ্যে প্রথমটি দেশের মূল বিরোধী দল।
মুইজজু প্রথম রাউন্ডে সলিথের চেয়ে প্রায় সাত ভাগ বেশি ভোট পাওয়ায় আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো কিছুটা বিস্মিত হয়েছে। এটা ঘটেছে ছোট-বড় কয়েকটি কারণে। প্রথমত, নাশিদ বেরিয়ে আসায় এমডিপির ভোট কমে গেছে। নাশিদ নতুন একটি দল করেছেন ডেমোক্র্যাটস নামে। এই দলের প্রার্থী নির্বাচনে ভাগ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। এই ভোটগুলো সম্ভবত সলিথের শিবির থেকেই গেছে। দ্বিতীয়ত এমডিপির প্রার্থী, বর্তমান প্রেসিডেন্টকে মানুষ ভারত-সমর্থক হিসেবে দেখছিলেন। আর মুইজজুকে বিবেচনা করা হয়েছে ভারতবিরোধী হিসেবে। রাজধানী মালের মেয়র হিসেবে দেশব্যাপী আগে থেকেই তাঁর পরিচিতিও রয়েছে।
মুইজজুর পক্ষে তৃতীয় সুবিধা ছিল, তাঁর জোটের মূল সমর্থক কারারুদ্ধ সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন দেশটির প্রভাবশালী এক পরিবারের লোক। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের ছোট সৎভাই তিনি। যদিও ইয়ামিনের সঙ্গে মামুন আবদুল গাইয়ুমের সম্পর্ক ভালো নয় এবং আদর্শিকভাবেও তাঁদের মধ্যে মিল কম; কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য কোনো না কোনোভাবে কাজ করেই। ৩০ বছরের ক্ষমতার জীবনে মামুন আবদুল গাইয়ুমের পেছনে ভারতের শক্তিশালী সহায়তা ছিল। কিন্তু ইয়ামিনের পরিচিতি তৈরি হয়ে উল্টোভাবে।
গত নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০০০ সালের অক্টোবর থেকে ইয়ামিন মালদ্বীপজুড়ে ‘ইন্ডিয়া-আউট’ নামে ভারতবিরোধী এক সামাজিক আন্দোলনে নেমেছিলেন। তাঁর বিরোধীরা এ রকম আন্দোলনের পেছনে চীনের উৎসাহ ছিল বলে মনে করেন। তবে সলিহের শাসনামলে মালদ্বীপে যে ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে, সেটা ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোই নিয়মিত বলছে। অন্যদিকে, মালদ্বীপের ভেতরে সলিহবিরোধীরা প্রেসিডেন্টের ‘ইন্ডিয়া-ফাস্ট’ নীতিকে বলছেন তাঁদের দেশের ‘সার্বভৌমত্বের আপস’। নির্বাচনে এ রকম উভয় তরফের প্রচারের যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে সলিহবিরোধীরা লাভবান হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
এগিয়ে চীনবান্ধব জোট
এবারের নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে মালদ্বীপে প্রায় ৭৯ ভাগ ভোট পড়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডেও এ রকম প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। বিগত নির্বাচনগুলোতে মালদ্বীপের মানুষ আরও বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নির্বাচনী ব্যবস্থার অধঃপতনের মধ্যেও মালদ্বীপে যে মানুষ এভাবে উৎসবের মনোভাব নিয়ে ভোট দিচ্ছেন, তা অভিনন্দন পাওয়ার মতো ব্যাপার। তবে ভোটের প্রতি নাগরিকদের এত আগ্রহের মূলে রয়েছে দেশটির ভেতরে তীব্র ও তিক্ত রাজনৈতিক মেরুকরণ। এই মেরুকরণে ইন্ধন রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিরও। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের অবস্থান বহু বিশ্বশক্তির কাছে ছোট্ট দেশটির বন্ধুমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে মালদ্বীপের চেয়ে বেশি উত্তেজনা বইছে বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে।
নির্বাচনকালে সাম্প্রতিক সংবাদগুলোতে ভারতীয় অনেক প্রচারমাধ্যম মুইজজুকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ও চীনের ‘ছদ্ম প্রার্থী’ বলেও উল্লেখ করেছে। এ রকম অভিমত যে সলিহের পক্ষে যায়নি, সেটা ভোটের ফল থেকেই স্পষ্ট। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে তিনি ৫8 ভাগের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। অথচ এবার ৯ ভাগ কমে গেল। এ থেকে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে, তাঁর সরকারের ভারতমুখী নীতি মালদ্বীপের সুন্নি মুসলমানেরা উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেননি।
এসব বিশ্বাসযোগ্য অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে কে জিতবেন? এ দফার ভোটে যে প্রথম রাউন্ডে তৃতীয় থেকে অষ্টম স্থান পাওয়া প্রার্থীদের সমর্থকেরা নির্ধারক ভূমিকা রাখবেন, সেটা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটসের সাত ভাগ ভোটারকে নিয়ে সলিহ ও মুইজজু উভয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন। সাধারণভাবে যা অনুমান, সলিহের সঙ্গে নাশিদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের তিক্ততার কারণে এই ভোটগুলো দ্বিতীয় রাউন্ডে বিরোধী দলের প্রার্থী মুইজজুর দিকে চলে যেতে পারে। ফলে তিনি বড় ব্যবধানে জিতে যেতে পারেন। তবে সলিহ চেষ্টা করছেন নাশিদের সঙ্গে তাঁর বিবাদ মীমাংসা করে ফেলতে।
সলিথের সমর্থক এমপিরা পার্লামেন্টে স্পিকার হিসেবে নাশিদের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে যে ভোটের ডাক দিয়েছিলেন, সেখান থেকে ইতিমধ্যে তাঁরা নাম প্রত্যাহার করতে শুরু করেছেন। এমডিপির সাবেক এই দুই নেতার মধ্যে সমঝোতা হলে নিশ্চিতভাবে ভোটের হিসাব আবার অন্য রকম হয়ে যাবে। সলিথের সঙ্গে বিবাদ মেটানোর জন্য নাশিদের ওপর ভারত ও ব্রিটেনেরও ব্যাপক চাপ রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও সে রকম কিছু চাইছে। কারণ, মুইজজুর বিজয় নির্বাচনে চীনের বিজয় হিসেবেই দেখা হবে এবং সে রকম হলেও ইয়ামিনও দণ্ড শেষ হওয়ার আগেই মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন—নয়াদিল্লি যা একদম চাইছে না।
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীদের পররাষ্ট্রনীতির এ রকম রাজনীতিকীকরণ সাম্প্রতিক একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হয়ে উঠেছে, যাকে ঠান্ডা যুদ্ধের নজরকাড়া প্রভাব হিসেবে দেখা যায়।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে গবেষক