আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে জনমনে যুগপৎ কৌতূহল এবং সংশয় রয়েছে। পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতাই এর কারণ। সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন কারও প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসের ওপর মানুষ ভরসা করতে পারছে না। নির্বাচনে হস্তক্ষেপের দায় এড়াতে প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর সরকারদলীয় কৌশলে কি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে? এর মধ্যে প্রায় বছর আটেক নিষ্ক্রিয়তা ও হতোদ্যম অবস্থা কাটিয়ে বিএনপি রাজপথের আন্দোলনকে চাঙা করতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে এতকাল যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব পশ্চিমা দেশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়ে গেছে, তাদের অবস্থানের যেন একটু পরিবর্তন ঘটেছে। তার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে র্যাব ও পুলিশের উচ্চপদস্থ সাবেক ও বর্তমান ছয়জন কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে। এখন তাঁদের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও রাষ্ট্রদূতের ভূমিকায় তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। এসবই মূলত মানবাধিকার ইস্যুতে তাঁদের অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য কিছুদিন দেনদরবার চালিয়েছে। তাতে কাজ না হওয়ায় এখন মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ পশ্চিমা দেশের একই বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বৈতনীতি ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগে বৈষম্যের দৃষ্টান্ত তুলে সমালোচনায় পিছপা হচ্ছে না। বাজারে এমন রবও রয়েছে যে প্রতিবেশী দেশও নানা কারণে আগের মতো বর্তমান সরকারের সার্বিক সমর্থনের নীতি থেকে সরে আসছে। বিপরীতে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে বিএনপি নেতাদের কথা বলতে শোনা যাচ্ছে এবং দলটির সমর্থনে সংখ্যালঘুদের পক্ষে একটি সংস্থাও গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালেও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও জৌলুশের সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে। কিন্তু এক বছরের মাথায় আকস্মিকভাবে তাদের প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাইরের বন্ধুদেশের আপাত–কঠোর অবস্থান। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কখনো একরৈখিক বা একই গতি ও বিন্যাসে চলে না। আমরা লক্ষ করছি এই সময়ে রাশিয়া, চীন এমনকি পশ্চিমের মিত্র জাপানও বাংলাদেশের প্রতি উষ্ণ আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে। ফলে এ সময় বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে কাজে প্রখর সতর্কতা, পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন হবে। এ কথা ঠিক, প্রায় ১৪ বছর ধরে সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা দক্ষ ও পোক্ত হয়ে উঠেছেন।
তাঁর সরকারের তিন মেয়াদের দীর্ঘ শাসনকালে দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিপুল উন্নতি হয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। অর্থনীতি ও সামাজিক সব সূচকেই এই অগ্রগতি দৃশ্যমান। তবে দুর্নীতি ও বৈষম্য, ব্যাংকিং খাতের সার্বিক দুর্বলতাও সাফল্যের পথে বাধা হয়ে আছে এবং ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচার যে বেড়েছে মারাত্মক পর্যায়ে, তাতে সন্দেহ নেই। দুদক আগের তুলনায় সক্রিয় হলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের বহর ও ব্যাপকতার তুলনায় এখনো এ ভূমিকা যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে যেকোনো মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা এত সময়সাপেক্ষ যে তাতে অপরাধ নিরুৎসাহিত হয় না, অপরাধীরা কঠোর কোনো বার্তা পায় না। সেই সঙ্গে এসব অপরাধের বিচারে দ্রুততা ও মন্থরতার সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না বলে শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী ও সচেতন মানুষের উৎকণ্ঠা কাটে না।
বড় বড় মেগা প্রকল্প হলো জাতীয় সম্পদ, সমষ্টির কল্যাণ সাধন করে। কিন্তু দুর্নীতি, আর্থিক ও দখলদারির অপরাধ, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ বা স্বজনতোষণ ইত্যাদি অপরাধ-অনিয়মের ভুক্তভোগী জাতি বা রাষ্ট্র ছাড়াও সরাসরি ব্যক্তি মানুষ। ফলে ব্যক্তির ক্ষোভ ও বিরূপ মনোভাবের ফল ভোগ করতে হয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে। তার ওপর দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা এবং গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যায়ের বেপরোয়া উচ্চাভিলাষী নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগ সামলাতে পারেনি। এমনকি বলা যায় নেতৃত্ব এ লক্ষ্যে যথেষ্ট তৎপর হয়নি। আত্মপক্ষে সাফাই গাওয়ার মতো কয়েকটি দৃষ্টান্ত অবশ্যই আছে—ক্যাসিনো-কাণ্ড, ফাহাদ হত্যা, ডেসটিনি, হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়। কিন্তু তা বোধ হয় চলমান ও ক্রমবর্ধমান অনিয়ম-অপরাধের দায় চুকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যথার্থ চাপ তৈরি না হওয়ায় প্রধান বিরোধী দল অবলীলায় জামায়াতকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় এসেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাদের অবস্থান আজ পর্যন্ত পরিষ্কার না করেও দেশের বৃহৎ একটি দলে পরিণত হতে পেরেছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির সবটার কৃতিত্ব ও পরিসর একক দখলে রাখতে চায়, তাই এই পরিণতির মূল দায় তারা এড়াতে পারে না। আর এ কারণেই নাগরিক সমাজের পক্ষেও যথার্থ ভূমিকা পালন ব্যাহত হয়েছে, হচ্ছে।
এতত্সত্ত্বেও আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের উভয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আওয়ামী লীগের কি সন্দিহান হওয়া সত্যিই যুক্তিযুক্ত ছিল? উপমহাদেশের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল এবং এলাকাভিত্তিক শক্তিশালী প্রার্থীদের যেটুকু বাড়াবাড়িকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় ভাবা হয় না, সেই রুটিন ভূমিকার মধ্যে থেকেও তাদের বিজয়ী হওয়া অসম্ভব ছিল না বলেই মনে হয়, হয়তো ভূমিধস বিজয় হতো না। কিন্তু সেই বিজয়ে সরকার ও দলের নৈতিক বল এতটাই জোরালো থাকত যে তাদের এভাবে আমলাতন্ত্র ও সরকারি বাহিনীর মুখাপেক্ষী হতে হতো না। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের জন্য এই অবস্থান বজায় রাখা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব নেতা-কর্মী বা গোয়েন্দা বাহিনী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয়ের বার্তা দিয়ে নেতৃত্বকে অস্থির বিভ্রান্ত করেছিল, তাদের পর্যালোচনা, পূর্বাভাস কোনোটাই ঠিক ছিল না বলে মনে করি।
তবে এটাও ঠিক, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা ও বক্তব্য সঠিকভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি, পারছে না। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি মাঠে নামার পর থেকে আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিন যে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, তা মূলত বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনে নিবদ্ধ থাকে। দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও তা-ই করছেন। দলনেত্রী প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সাম্প্রতিক জনসভার ভাষণে সিংহভাগ এভাবেই ব্যয় করেছেন। প্রতিপক্ষের সমালোচনা ও যুক্তি খণ্ডনে তাঁদের বক্তব্যে যে ধার থাকে, তা নিজেদের অর্জনের প্রকাশ-প্রচারের ক্ষেত্রে অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান সরকার এক যুগে যে পরিমাণ কাজ করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা যে মাত্রা অর্জন করেছে, তার তুলনীয় কাজ বাংলাদেশে কখনো হয়নি।
আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসর ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, দুই-এক দশকের মধ্যে তা ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলবে। প্রবৃদ্ধি করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও গতিশীল রয়েছে। দরিদ্রবান্ধব যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলো অতীতের যেকোনো কার্যক্রমের তুলনায় অনেক ব্যাপক ও ফলপ্রসূ হচ্ছে। কিছু দুর্নীতি বা অদক্ষতার অভিযোগ সত্ত্বেও এ কথা বলা যায়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বা টানেলের মতো বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার সাহসও অতীতে দেখা যায়নি। রূপপুর নিয়ে আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা থাকলেও লাখো কোটি টাকার প্রকল্পের সাহসকে তারিফ করতে হয়। বাংলাদেশের কোনো নেতাই অতীতে দেশ নিয়ে এতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাবনায় যেতে পারেননি। সাহস করে বাস্তবায়ন দূরের কথা।
তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাদের রাজনীতিকে, বিশেষত বিএনপির চেয়েও গুণগত ভিন্নতা-শ্রেয়তা প্রমাণের জন্য কেবল যেন ঐতিহাসিক দায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা লক্ষ্য–আদর্শ বাস্তবায়ন কেবল একাত্তরের ও পঁচাত্তরের অপরাধীদের বিচার ও শাস্তিতে সম্পন্ন করা যায় না। ঠিক তেমনি কেবল উন্নয়নের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কায়েমও নিশ্চিত হয় না। আওয়ামী লীগের সামনে আসল চ্যালেঞ্জ ছিল পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় অসাম্প্রদায়িক মানবিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শকেই মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধীরা, যারা অসাম্প্রদায়িকতা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বিশ্বাস করে না; যারা ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, এমনকি জঙ্গিবাদের প্রতি দুর্বল, তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় রয়েছে। কেবল তা নয়, বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যেও একাত্তরের চেতনার পরিবর্তে উদীয়মান মুসলিম জাতীয়তার কালচারের প্রকোপ দেখা যায়।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যথার্থ চাপ তৈরি না হওয়ায় প্রধান বিরোধী দল অবলীলায় জামায়াতকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় এসেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাদের অবস্থান আজ পর্যন্ত পরিষ্কার না করেও দেশের বৃহৎ একটি দলে পরিণত হতে পেরেছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির সবটার কৃতিত্ব ও পরিসর একক দখলে রাখতে চায়, তাই এই পরিণতির মূল দায় তারা এড়াতে পারে না। আর এ কারণেই নাগরিক সমাজের পক্ষেও যথার্থ ভূমিকা পালন ব্যাহত হয়েছে, হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে যেটুকু এগিয়ে নিয়েছে, তাকে টেকসই করা এবং চলমান রাখার জন্য বর্তমান ধারার অস্পষ্ট রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। তবেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রতিক্রিয়াশীল পিছুটান ও স্থবিরতা থেকে মুক্ত হতে পারবে। এর জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির বৃহৎ পরিসর গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সক্রিয় এ ধারার সব শক্তির এককভাবে ও সম্মিলিত হয়ে কাজের সুযোগ গড়তে হবে। ক্ষমতার দাপট, অপব্যবহার, অর্থবিত্তের বেপরোয়া উচ্চাভিলাষ, রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, সুবিধাবাদ ও আপস বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার উদ্দেশ্য সাধনের রাজনীতির লাইন নিতে হবে। সেই রাজনীতিকে বৃহত্তর ঐক্যের ও নবজাগরণের পথে চালিত করেই আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং দেশের স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবে। নয়তো সরকারে থেকে উন্নয়নের বহুতর কাজ করেও রাজনৈতিক পরাভব এড়ানো যাবে না।
● আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক