পাকিস্তানকে আশকারা দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছে যুক্তরাষ্ট্র

পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ দূরে থাক, বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে উল্টো ‘প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।
ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র তার ভুল থেকে খুব কমই শিক্ষা নেয়। এর কারণ হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যান্স মরজেনথাউ ‘স্ট্র্যাটেজিক নার্সিসিজম’ বা ‘কৌশলগত নার্সিসিজম’ বলে যে ‘রোগের’ কথা উল্লেখ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বহু আগে থেকে সেই ‘রোগে’ ভুগছে। প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করে এসেছেন, বিশ্ব তাঁদের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে এবং তাঁরা এ ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের কৌশল–নীতি তৈরি করে থাকেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত কড়া নীতি থেকে সরে এসে আবার দেশটিকে দুধকলা দেওয়া শুরু করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে, তিনি অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে বদ্ধপরিকর।

পাকিস্তানের দুর্বৃত্তায়িত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারি পাকিস্তানকে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সশস্ত্র জিহাদিদের নিয়োগ করাকে অনুমোদন দেয়—এ সত্য উপলব্ধি করতে একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ হয়েছেন।

আরও পড়ুন

পাকিস্তান বরাবরই আফগানিস্তানকে উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করেছে। তারা ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে তালেবান তৈরি করে আফগানিস্তানে এমন একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল, যা আফগানিস্তানকে কার্যত পাকিস্তানের উপনিবেশ বানিয়ে ফেলেছিল। আইএসআই কলকাঠি নেড়ে আফগানিস্তানে আমেরিকার অপমানজনক পরাজয় নিশ্চিত করার পর সেখানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণে সব ফিরে এসেছে এবং এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।

পাকিস্তান নিজেই চরমপন্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। তারা জাতিসংঘের ঘোষিত একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমির পাশেই বসবাসরত অবস্থায় পেয়েছিল। আল–কায়েদার থার্ড ইন কমান্ড খালিদ শেখ মোহাম্মদসহ নাইন–ইলেভেন হামলার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারীরা পাকিস্তানেই ধরা পড়েছিলেন। এখনো সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পরও পাকিস্তানের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং আইএসআই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দায় থেকে মুক্ত রয়েছে।

ধারদেনায় দেউলিয়াপ্রায় পাকিস্তান বেইলআউটের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রসমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করতে বাইডেন এ বিষয়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতেন।

নাইন–ইলেভেন হামলার সাম্প্রতিক ২১তম বার্ষিকীতে বাইডেন ‘যেখানেই তারা থাকুক, আমরা তাদের খুঁজে বের করব’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করতে এবং হত্যা করতে দশ বছর লেগেছে।’ তবে বিরক্তিকরভাবে তিনি তাঁর পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিকে উল্টে দিয়েছেন এবং পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করা সত্ত্বেও তাঁর প্রশাসন ইসলামাবাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখছে।

ধারদেনায় দেউলিয়াপ্রায় পাকিস্তান বেইলআউটের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রসমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করতে বাইডেন এ বিষয়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতেন।

এর বদলে বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি পাকিস্তানকে ১১০ কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ অবিলম্বে বিতরণের জন্য আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদন সুরক্ষিত করেছে। এর মাধ্যমে তারা পাকিস্তানকে ঋণখেলাপি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

পাকিস্তানের ওপর বাইডেন প্রশাসনের এটিই একমাত্র সহায়তা নয়; আমেরিকা ও চীনের সমর্থনে পাকিস্তান প্যারিসভিত্তিক সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইকারী আন্তসরকারি সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ‘ধূসর তালিকা’ থেকে বেরিয়ে আসার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে।

সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নকে মেনে নেওয়ার অভিযোগে ২০১৮ সালে পাকিস্তানকে এ তালিকায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের এ অভিযোগকে আমলে নেয়নি এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ঠেকাতে দেশটি সামান্যই তৎপর ছিল।

আরও পড়ুন

প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানকে এফএটিএফের সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ‘কালো’ তালিকায় রাখা উচিত ছিল। ওই তালিকায় থাকলে এত দিন পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপিত হতো। কিন্তু আমেরিকান সেনারা ওই সময় তালেবানের সঙ্গে লড়াই করছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিকে মধ্যপন্থী করতে চাইছিলেন। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এফএটিএফের কালো তালিকায় পাকিস্তানের নাম যাতে না পড়ে, সে জন্য সফলভাবে তদবির করেছিল।

ভারতের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে—এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও অর্থসংকটে থাকা পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা এফ-১৬ বিমানবহরের আধুনিককরণে এই মাসে বাইডেন প্রশাসন ৪৫ কোটি ডলার সহায়তা দেবে বলে চুক্তি করেছে।

কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দাঁতে শাণ দিতে সশস্ত্র করে রেখেছে। ভারতবিরোধিতার কৌশল হিসেবে চীনও এটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তান দখলকারী সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন যুদ্ধের মঞ্চ হিসেবে কাজ করার পুরস্কারস্বরূপ পাকিস্তানকে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় পাকিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গোপনে তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেছিল।

পাকিস্তানের চারটি সক্রিয় এফ-১৬ স্কোয়াড্রন ভারতের বিরুদ্ধে বিমানযুদ্ধ পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই স্কোয়াড্রনের কোনো কোনোটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে চলা সংঘর্ষে নিয়োজিত ছিল।
পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানকে অত্যাধুনিক এভিওনিক্স (বিশেষ ধরনের স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিকস সিস্টেম) দিয়ে সজ্জিত করা সন্ত্রাস দমনে সহায়ক হবে বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিকে ন্যায্যতা দিয়েছে। কিন্তু এ পদক্ষেপ ভারতকে সতর্ক না করে ঘোষণা করা হয়েছে, যা সম্ভবত ভারতীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে সংশয় বাড়িয়ে দেবে।

বাইডেন ভারতের বিরুদ্ধে চীনের ২৮ মাসব্যাপী সীমান্ত আগ্রাসন সম্পর্কে কিছুই বলেননি এবং তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিরপেক্ষ থাকার পথ বেছে নিয়ে দুটি শক্তিকে (ভারত ও চীনকে) ‘একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান’ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের মক্কেলরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শক্তিশালী করে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ চুক্তি করা মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে আরও বিঘ্নিত করবে।

তালেবানকে আমেরিকান সেনাদের হত্যায় সহায়তা করার পরও আমেরিকা পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। উল্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এ অঞ্চলে তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বাররক্ষক হিসেবে বিবেচনা করছে।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের জন্য পাকিস্তান প্রধান ভূমিকার নেওয়ায় যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে বাইডেনের এই সোত্সাহী সম্পর্ক স্থাপন তাদের সে আহ্বানকে খারিজ করে দিয়েছে।

পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকায় পাকিস্তানকে যোগ করা দূরে থাক, বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে উল্টো ‘প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। বিশ্বের আরও ১৭টি দেশকেও এ মর্যাদা দেওয়া হলেও ভারত তা পায়নি।

এ অবস্থাকে চমকানোর মতো কোনো বিষয় হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। তালেবানকে আমেরিকান সেনাদের হত্যায় সহায়তা করার পরও আমেরিকা পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। উল্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এ অঞ্চলে তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বাররক্ষক হিসেবে বিবেচনা করছে।

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার অপমানজনক বিদায় আইএসআইয়ের ওপর আমেরিকার নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে। এতে তালেবান বাইডেন প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার আরও বাইরে চলে গেছে।

মার্কিন ড্রোন হামলায় কাবুলে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির সাম্প্রতিক হত্যা পাকিস্তানি আকাশসীমায় মার্কিন প্রবেশাধিকার ছাড়া সম্ভব হতো না। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ‘যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান অংশীদারি বাড়ানোর’ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এ ঘটনা সেই প্রতিশ্রুতিকেই ব্যাখ্যা করে।

পূর্ববর্তী মার্কিন ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে বাইডেন প্রশাসনের অনীহা এটি নিশ্চিত করে যে স্বল্পমেয়াদি ভূরাজনৈতিক বিবেচনা আমেরিকান স্বার্থের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ক্ষতি করবে জেনেও আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি সে পথেই চলবে।

বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদিবাদের একটি প্রধান কেন্দ্রকে লালন করবে এবং পাকিস্তানকে অগ্নিনির্বাপক হওয়ার ভান করে এ অঞ্চলে আগুন লাগানোর অনুমতি দেবে।

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট;

    অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক