সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, উপাচার্য নিয়োগ, তাঁদের অনেকের নীতি ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি বিব্রতকর বিষয় নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। তার কিয়দংশও যদি সত্যি হয়, এটা কিন্তু মহামারির রূপ ধারণ করেছে বলা যায়—যার প্রভাব কেবল শিক্ষা খাতে নয়, সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত। এ পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য।
এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে বা নিকটাত্মীয়কে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেবেন, টাকা বা বিয়ের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিয়ে অডিও-ভিডিও, ফোনালাপসহ যেসব খবর সারা দেশে ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে।
অনেক প্রথিতযশা শিক্ষক আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। অথচ কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে সত্যি সত্যি জাতির অভিভাবকসম ছিলেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে এখন প্রায় সর্বত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানসম্মান ও মর্যাদা একেবারেই তলানিতে বলা যায়। এ অবস্থায় উপাচার্য নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা—সবকিছুকে নতুন করে স্বচ্ছতার সঙ্গে জবাবদিহির আওতায় আনার বিকল্প নেই।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিই একজন উপাচার্যের মূল কাজ। তাঁকে যখন এই কাজ উপেক্ষা করে অন্য কাজে বেশি মনোযোগী হতে হয়, তখন তাঁর পক্ষে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন সাধন প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা-ই ঘটছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ইতিমধ্যে তিন সপ্তাহব্যাপী সংবাদ প্রদর্শনী করেছে, যেখানে মূলত বর্তমান প্রশাসন কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত নানা রকমের নীতি ও নিয়মবহির্ভূত অপকর্মের (১৯৭৩ বিধিবিরোধী) সংবাদ (দুই শতাধিক) স্থান পেয়েছে। এমন অনিয়মের বেশ কিছু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কম-বেশি লক্ষণীয়।
এ অবস্থা একদিকে শিক্ষার পরিবেশের জন্য ঝুঁকিকর; অন্যদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পথে বাধা। শিক্ষা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা সমাজের সব খাতকে কেবল স্পর্শ করে না, প্রভূতভাবে প্রভাবিত করে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যায় বৃদ্ধি করা নয়, গুণগত মান নিশ্চিত করা প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। তাই উচ্চশিক্ষাসহ শিক্ষার সব স্তরে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ আনয়ন এবং শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা প্রদান দেশের উন্নয়নের জন্যই অপরিহার্য।
বর্তমানে একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় পরিদৃষ্ট যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ যদি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতমদের (শিক্ষা, গবেষণা, প্রগতি, মুক্তবুদ্ধি, গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিবেচনায়) মধ্য থেকে, এবং বিশেষ করে কর্মরতদের মধ্য থেকে করা হয় (অন্তত পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে), তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কিছুদিন পরপর যে অনাস্থা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা অনেকটা কমে আসত।
সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে এটা নিশ্চিত যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিধিসম্মতভাবে (একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতার ভিত্তিতে; কেবল রাজনৈতিক বা আঞ্চলিক বিবেচনায় নয়) উপাচার্য নিয়োগ হলে, উদ্ভূত সমস্যা থেকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও সে ক্ষেত্রে কতগুলো দিক বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা দরকার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য যদি অবসরপ্রাপ্ত হন, সেটা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অসম্মানজনক। তা ছাড়া ভারপ্রাপ্ত হলেও কেন তা অনির্ধারিত সময়ের জন্য (এমনকি চার বছরের বেশি সময়) চলতে থাকবে, তা মোটেও বোধগম্য নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং এমনকি রেজিস্ট্রার সবাই অবসরপ্রাপ্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন ও চারটি প্রধান স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠানের জন্য বিষয়টি একেবারেই বেমানান। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আর বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করেন না; শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থ অপেক্ষা নিজের আখের গোছানোতে তাঁরা বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন।
দেখা যায়, তাঁদের অপকর্মে সহায়তা দিয়ে গুটিকয়েক শিক্ষকও নানা ধরনের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ রকম অসম্মান ও স্বায়ত্তশাসনের অপপ্রয়োগ থেকে মুক্ত করতে হবে।
ওপর থেকে কিংবা কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা কিংবা শিক্ষকদের পাঠদান বা গবেষণা অপেক্ষা ক্ষমতাবানদের খুশি রাখায় তাঁকে সদা ব্যস্ত থাকতে হয়।
যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষককে নিয়োগ না দিয়ে, চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে আসা বা অবসরপ্রাপ্ত অথবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে ওপর পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি ওপর পর্যায়ের মনমর্জি ঠিক রাখতে এবং অপরাপর কাজে মনোনিবেশ করেন বেশি। আহমদ ছফার ‘গাভি বিত্তান্ত’ এ প্রসঙ্গে সহায়ক পাঠ্য।
বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন, কোনো উপাচার্য যদি দুর্নীতি করেন, তাঁর অবসরের পর কিংবা তাঁর দায়িত্বকাল অতিক্রান্ত হলে তাঁকে আর জবাবদিহি করতে হয় না। উপাচার্যরা কেন আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন! বেশ কয়েকজন উপাচার্যের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তাদের বিচারের আওতায় আনার কোনো নজির নেই।
শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকলে কীভাবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাহিনি রাষ্ট্র হয়! আইনের শাসন ও জবাবদিহি থাকলে কোনো উপাচার্য দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে কীভাবে অনুপস্থিত থাকেন?
কোনো কোনো উপাচার্য আবার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম ছেড়ে ঢাকায় অবস্থানকে অগ্রাধিকার দেন পদ টিকিয়ে রাখার নানা কৌশল অবলম্বনের জন্য। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য নিজস্ব বলয় ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কীভাবে আরেক উপাচার্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেন?
উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েই যেন তাঁদের কেউ কেউ শুরু করেন নিয়োগযজ্ঞ। এক উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন তাঁর ছেলে, মেয়ে, শ্যালক ও ভাতিজাকে। কোনো কোনো উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে রীতিমতো নিয়োগের বাজারে পরিণত করেছেন। কীভাবে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেয়ের চাকরির জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট অন্যায়ভাবে দ্বারস্থ হন!
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার বিষয়টি তো আমাদের সামনেই আছে। না জানি কল রেকর্ড ফাঁস না হওয়া, এমন কত অনিয়মই না ঘটে গেছে এবং সেসব অগোচরেই থেকে গেছে!
এত এত অন্যায়ের পর যখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে উপাচার্যের অন্যায়ের বিরোধিতা করে আন্দোলন করে তখন তাদের আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সব ধরনের চেষ্টা করে (যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকসমাজ যদি তাদের সব স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা জলাঞ্জলি দিয়ে এবং সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিকূলতার সম্ভাবনা মাথায় রেখে আন্দোলনে এমনকি অনশনের মতো কর্মসূচিতে বাধ্য হয়; সে পরিস্থিতিতে কোনো বিতর্কিত উপাচার্যকে কর্তৃপক্ষের সমর্থন প্রদান কিংবা সহ্য করা কোনো দিন ইতিবাচক ফলাফল আনে না।
নিয়োগ দেওয়া মানে তাঁর সব কাজের (বিশেষত অপকর্মের) ভার বহন করা নয়। নৈতিক স্খলন, অসদাচরণ, স্বৈরাচার মনোবৃত্তি ও দুর্নীতি ইত্যাদির প্রমাণ থাকলেও কেন একজন উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয় না বা পদত্যাগে বাধ্য করা হয় না; বোধগম্য নয়।
একবার নিয়োগ দিলেই কি তাঁর সব কাজের সমর্থন দিতে হবে, আর কি বিবেচনা করা যায় না! ভালো কাজের পুরস্কার যেমন দরকার, তেমন মন্দ কাজের জন্য, অপকর্মের জন্য এবং অযোগ্যতার জন্য জবাবদিহি ও তিরস্কারও আবশ্যক। এটাই হওয়া উচিত বাঞ্ছিত ব্যবস্থাপনা।
বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন, কোনো উপাচার্য যদি দুর্নীতি করেন, তাঁর অবসরের পর কিংবা তাঁর দায়িত্বকাল অতিক্রান্ত হলে তাঁকে আর জবাবদিহি করতে হয় না। উপাচার্যরা কেন আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন! বেশ কয়েকজন উপাচার্যের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তাদের বিচারের আওতায় আনার কোনো নজির নেই। বিচারহীনতার ফলে কর্মরত উপাচার্যরা তাঁদের আগের উপাচার্যের অনিয়ম বা দুর্নীতিকে ছাপিয়ে যান। জনগণের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন খেসারত কোনোভাবেই কাম্য নয়।
শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষার্থীদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়ন, শিক্ষকদের পদোন্নতি আটকানো কিংবা নানান অজুহাতে তদন্ত কমিটি গঠন করে ভীতসন্ত্রস্ত করে এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে কিংবা সংকোচন করে বিশ্ববিদ্যালয় তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।
শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু না হলে, শিক্ষা ও গবেষণা ফলপ্রসূ হয় না। আর যেহেতু সমাজের সর্বস্তরেই শিক্ষার অবিচ্ছিন্ন সংযোগ, তাই শিক্ষাকে অবহেলিত বা ঝুঁকির মধ্যে রেখে শিক্ষা ও বাদবাকি সব স্তরের সুষম বিকাশ সম্ভব নয়।
যত দিন না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হবে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংয়ে কখনোই প্রত্যাশিত অবস্থায় যেতে পারবে না। স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পাঁচ দশক হতে চলল; এখন অবধি না পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়িত হয়েছে; না স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা রক্ষা পেয়েছে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে এটা গভীরভাবে ভাবতে হবে।
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধিসম্মত পন্থায় উপাচার্য নিয়োগ, শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখা, শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধির দিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন।
ড. আলা উদ্দিন অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]