হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল স্রেফ মশকরা

স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের আগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান আজিজ আহমেদ এবং এনবিআর পরিচালক মতিউর রহমানের দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনি সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু হাসিনার পদক্ষেপগুলো জনগণের সঙ্গে নিষ্ঠুর মশকরা ছিল। অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে দিয়ে হাসিনা দুর্নীতিকে সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করেছিলেন।

সাবেক আইজিপি বেনজীর হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ২০০৯ সাল থেকেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। সেই সুবাদে হাসিনার সব রকমের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, বৈধ-অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনে তিনি সার্বক্ষণিক প্রয়াস রেখেছেন।

ঢাকার মেট্রোপলিটন কমিশনার থেকে র‌্যাবের মহাপরিচালক হয়ে পুলিশের আইজিপি পদে তাঁর পদোন্নতি অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। তাঁর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক অপরাধ ছিল ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরিয়ে ফেলার কেলেঙ্কারি।

হাসিনার সরকারকে বড় বড় অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে বেনজীরের বেলাগাম দুর্নীতি ও অঢেল অবৈধ অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে তাঁর চাকরিকালীন সময়ে হাসিনা থেকে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

সরকারের কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরই সম্ভবত ফলাও করে তাঁর নানাবিধ দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কেচ্ছাকাহিনিগুলো সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। অবশ্য, সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছিল যে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর লোকদেখানোর তাগিদে এসব কাহিনির অবতারণা করা হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের ব্যাপারটিও একই ধরনের। আল-জাজিরা টেলিভিশনের ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ অনুষ্ঠানটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে জেনারেল আজিজ তাঁর ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে হাসিনা সরকারের আমলেই তাঁর এক ভাইয়ের খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমার’ আওতায় মাফ করিয়ে নিয়েছিলেন।

আল-জাজিরার ওই অনুষ্ঠানে আজিজের আরও অনেক অবৈধ কীর্তিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনী জালিয়াতির সময়েও আজিজই ছিলেন সেনাপ্রধান। ২০০৯ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সাড়ে ১৫ বছর ধরে দুর্নীতির ব্যাপারে হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রচণ্ডভাবে আশকারা দেওয়ার শামিল।

২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েই ২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অরডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে আবার ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন গোলাম রহমান। একবুক হতাশা নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন জেনারেল হাসান মসউদ।

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড লুটপাটের শিকার করে রেখেছিল হাসিনার সরকার। মোট ১৮ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে, যার অধিকাংশই দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। (সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা দাবি করেছে যে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ সাত লাখ কোটি টাকার বেশি)।

অথচ যে কয়েক শ রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ এই লুটপাট যজ্ঞের প্রধান কুশীলব, তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে হাসিনা সরকার ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়। (১৯৯৮ সালে সব ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রস্তাব করেছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ)।

বরং দুঃখজনকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি সালমান এফ রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বানিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বৈরাচারী হাসিনার অন্যতম দোসর সালমান রহমান গত ১৩ আগস্ট ছদ্মবেশে নদীপথে পালানোর সময় কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়েছেন। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকঋণ-লুটেরা ও সর্ববৃহৎ-রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি সালমান রহমানের এত করুণ পরিণতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে।

ধবধবে সাদা দাঁড়ি, সাদা চুলওয়ালা এবং সাদা পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় তাঁকে সব সময় দেখা যেত বলে ওয়াকিবহাল জনগণের বিরাট অংশ কৌতুক করে ‘দরবেশ’ নামেই ডাকত। তাঁর সার্বক্ষণিক দুষ্কর্মগুলো তাঁর ওই বেশভূষার একেবারেই বিপরীত বার্তা পৌঁছে দিত সবার কাছে। হাসিনা তাঁকেই বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টার পদটি দিয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে।

সালমান রহমান ৫২ বছর ধরেই দেশের অর্থনীতিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজি লুটপাটের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার ১৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের খবরে বলা হচ্ছে, গত ৫২ বছরে সে ব্যাংকিং খাতের সাতটি ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ-লুণ্ঠনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। শুধু জনতা ব্যাংক থেকেই সে ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাঁর মালিকানার আইএফআইসি ব্যাংক থেকে তিনি নাকি অবৈধভাবে ঋণ নিয়েছেন ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল ঋণের অতি ক্ষুদ্র অংশই ব্যাংকে ফেরত এসেছে বা ভবিষ্যতে আসবে।

যে কয়েক হাজার পুঁজি পাচারকারী দেশ থেকে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও হাসিনা সরকার কিছুই করেনি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত তিন বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও হাসিনা সরকারের টনক নড়েনি।

দুর্নীতি দমন, খেলাপি ঋণের মারাত্মক বিস্তার এবং পুঁজি পাচার দমনে হাসিনা সরকার মোটেও আন্তরিক ছিলেন না। দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ ছিল শুধুই রাজনৈতিক বাত্-কা-বাত্। পুঁজি পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের বেলাগাম বিস্তারের মধ্যে। পুঁজি-লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীরা ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’।

আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান।

এ পর্যায়ে আমি স্মরণ করছি ২০০৭-৮ সালে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কার্যক্রম চালিয়েছিল, তার সাফল্যকে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান মসউদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের একটি প্রবল ‘ঝাঁকুনি’ দিতে সক্ষম হয়েছিল বলে দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মন্তব্য করেছিলেন।

২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েই ২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অরডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে আবার ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন গোলাম রহমান। একবুক হতাশা নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন জেনারেল হাসান মসউদ।

আমার প্রস্তাব, ওই দুদক অর্ডিন্যান্সটিকে অবিলম্বে পুনঃপ্রবর্তন করা হোক। এবং একই সঙ্গে এমন একজনকে দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক যিনি সাহসের সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ রাখতে পারবেন। আমাদের প্রশাসনে এমন অনেকেই আছেন যিনি বা যাঁরা বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি দমনে সাহসী ভূমিকার জন্য পরিচিতি পেয়েছেন এবং জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক