এমপিদের ‘জমিদারি’ ঠেকানোর উপায় আনুপাতিক নির্বাচন

সংসদ সদস্যদের বর্তমান দ্বৈত ভূমিকার অবসান ঘটিয়ে তাঁদের ভূমিকা শুধু জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধ রাখা দরকার এবং স্থানীয় ইস্যুতে যাতে স্থানীয় সরকারগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য উপযোগী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু এলাকাভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা বজায় রেখে কেন এটা সম্ভব নয়, তা নিয়ে লিখেছেন নজরুল ইসলাম

রাজনীতিবিষয়ক জনপ্রিয় লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বাংলাদেশের বিগত সময়ের জমিদার এমপিদের (সংসদ সদস্য) একটি চমৎকার বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে এসব এমপি একদিকে বেশির ভাগ সময় ঢাকায় বসবাস করেন; রাজউকের বরাদ্দকৃত জমি উপভোগ করেন; এমপিদের জন্য ঢাকায় নির্মিত ফ্ল্যাট দখলে রাখেন; শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা ভোগ করেন ইত্যাদি।

অন্যদিকে তাঁরা নিজ এলাকায় প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করেন; এলাকার ঠিকাদারি ও ইজারাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন, স্থানীয় সরকারের পদ আত্মীয়স্বজন ও অনুচরদের দ্বারা দখল করেন, এলাকায় অবস্থিত স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালন বোর্ডের নিজেই সভাপতি হন অথবা সেগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন; এককথায় এলাকার জমিদার হয়ে বসেন।

এমপি হওয়ার জন্য তাঁরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন এবং এমপি হওয়ার পর এই পদ ব্যবহার করে তার বহুগুণ ধনসম্পদের অধিকারী হন। অনেকে শুধু এতেই সন্তুষ্ট থাকেন না, তাঁরা মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, মজুতদারি ইত্যাদিতে নিমজ্জিত হন। কেউ কেউ গাড়িতে বসে পাখি শিকারের মতো এলাকার অসহায় লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ–বিষয়ক আলোচনায় কদাচিৎ তাঁদের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ অংশগ্রহণ চোখে পড়ে। সংসদে তাঁদের দ্বারা স্বাধীনভাবে কোনো বিল উত্থাপনের উদাহরণ তার চেয়েও বিরল।

এলাকাভিত্তিক নির্বাচিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা জাতীয় ও স্থানীয়, উভয় পর্যায়ের ক্ষমতার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান। তাঁরা জাতীয় ক্ষমতার প্রতিভূ হন, কারণ, তাঁরা জাতীয় সংসদের সদস্য। সে হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের এমনিতেই প্রভাব থাকার কথা; কিন্তু তাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করেন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে নিয়েছেন।

সরকারি ও বিরোধী দল—উভয়ের এমপিদেরই এসব আইনের প্রতি সোৎসাহ সমর্থন ছিল। এ কারণে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা আরও খর্ব হয়েছে। এমপিদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখতিয়ার আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রত্যাশিত ধারায় ও মাত্রায় বিকশিত হতে পারেনি।

প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা যায়। উত্তরটির ইঙ্গিতও মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর নিবন্ধে দিয়েছেন। উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ‘এমপিদের জমিদারি প্রথা কি বহাল থাকবে, নাকি তাঁরা স্থানীয় প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে আইন প্রণয়নের কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন, সংসদে জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করবেন, সে ব্যাপারে একটা মীমাংসা হওয়া দরকার।’

সংক্ষেপে, এমপিদের বর্তমান দ্বৈত ভূমিকার অবসান ঘটিয়ে তাঁদের ভূমিকা শুধু জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধ রাখা দরকার এবং স্থানীয় ইস্যুতে যাতে স্থানীয় সরকারগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য উপযোগী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু এলাকাভিত্তিক এমপি নির্বাচনব্যবস্থা বজায় রেখে এটা সম্ভব নয়।

অতীতে আমরা যেমন দেখেছি, ভবিষ্যতেও এলাকাভিত্তিক এমপিদের দ্বারা গঠিত সংসদ স্বীয় এলাকার ওপর এমপিদের ক্ষমতা দিন দিন বাড়িয়েই চলবে। কারণ, তাতে তাঁদের বস্তুগত স্বার্থ নিহিত। সুতরাং যেটা প্রয়োজন তা হলো, এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের পরিবর্তে আনুপাতিক নির্বাচনের প্রবর্তন, যে নির্বাচনে এমপিরা কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবেন না। তাঁদের প্রত্যেকের নির্বাচনী এলাকা হবে গোটা দেশ। এটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, তাঁরা আইন প্রণয়ন করবেন গোটা দেশের জন্য, কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার জন্য নয়।

আনুপাতিক নির্বাচনের আগে প্রতি দল ক্রমাধিকারসম্পন্ন তাদের প্রার্থীর তালিকা দেশবাসীর কাছে উত্থাপন করবে এবং নির্বাচনে ভোটাররা বিভিন্ন দলের প্রতীকে ভোট দেবেন। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দলের জন্য সংসদের তত শতাংশ আসন বরাদ্দ হবে এবং তাদের পূর্বঘোষিত তালিকার ওপর থেকে সেই কয়জন প্রার্থী সংসদের সদস্য হবেন।

এর ফলে এমপিদের স্থানীয় ভূমিকার অবসান ঘটবে এবং তাদের ভূমিকা কেবল জাতীয় ইস্যুতে নিবদ্ধ থাকবে। এর ফলে স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বীয় ভূমিকা পালন এবং তার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগের সৃষ্টি হবে।

অনেকে আনুপাতিক নির্বাচন সম্পর্কে নিরুৎসাহিত বোধ করেন এই কারণে যে, এতে সব এলাকার সমহারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত থাকে না। যেটা বোঝা প্রয়োজন তা হলো, সংসদের সব এলাকার সমহারে প্রতিনিধিত্ব আছে কি না, সেটা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, সংসদের এমন ধরনের ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটছে কি না, যাঁরা জাতীয় ইস্যু সম্পর্কে দেশের সব এলাকার প্রতি সমগুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গম।

মহিউদ্দিন আহমদের আলোচনা দেখায় যে, তা না হলে সব এলাকা থেকে সমহারে এমপি নিশ্চিত করেও ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হবে না। তদুপরি, আনুপাতিক নির্বাচনেও যে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উপায় নেই, তা–ও নয়। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত আনুপাতিক নির্বাচন—কী এবং কেন বইয়ে আমি আরও আলোচনা করেছি। উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা তা দেখতে পারেন।

এটা আনন্দের বিষয় যে বর্তমানে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে মূল ব্যতিক্রম হচ্ছে বিএনপি। বিএনপি বরং জোর দিচ্ছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের ওপর।

রাষ্ট্র সংস্কার এবং সংবিধান সংশোধন শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি বইয়ে আমি দেখিয়েছি যে সাধারণভাবে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন হয় দুই পরিস্থিতিতে। একটি হলো, যখন একটি দেশের রাষ্ট্রকাঠামো ফেডারেল পদ্ধতির হয়, তখন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি উচ্চকক্ষের প্রয়োজন হয়, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়।

দ্বিতীয় হলো, যখন একটি দেশে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি থাকে, যাদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি উচ্চকক্ষের প্রয়োজন হয়, যেমন যুক্তরাজ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশের জন্য এ দুইয়ের কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। তা সত্ত্বেও কেন বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়।

বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির ৫ নম্বর দফায় বলা হয়, ‘বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে “উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা” প্রবর্তন করা হবে।’

ঠিক কী পদ্ধতিতে এই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে, তা এখান থেকে পরিষ্কার নয়। আনুপাতিক পদ্ধতিতেও এই কক্ষ গঠিত হতে পারে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিম্নকক্ষের আপেক্ষিকে এই উচ্চকক্ষের ভূমিকা কী হবে। উচ্চকক্ষ কী শুধু অলংকারিক হবে, নাকি এর উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা থাকবে।

দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি কী হবে? এসব বিষয়ে বিএনপির কাছ থেকে এ পর্যন্ত তেমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে শুধু অলংকারিক একটি উচ্চকক্ষ গঠনের সুফল কী হবে, তা স্পষ্ট নয়, বোঝা কঠিন। সুতরাং উচ্চকক্ষ–সংক্রান্ত বিএনপির দাবির যৌক্তিকতা বোঝা কঠিন।

তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আরেকটি যে বিকল্পের কথা ভাবা যেতে পারে তা হলো, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সমবায়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের ফোরাম গঠন। যেমন বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা এবং ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। এসব জেলা পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদের সভাপতিদের নিয়ে একটি ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’ গঠন করা যেতে পারে এবং এই পরিষদকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া যেতে পারে।

এর একটি হলো, দেশের বাজেট পর্যালোচনা এবং সে সম্পর্কে সুপারিশ প্রদান। দ্বিতীয় হলো, দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংসদের সম্ভাব্য অচলাবস্থার নিরসন। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদন সাপেক্ষে করা যেতে পারে এবং সংসদে এ বিষয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে বিষয়টি সংসদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদের যৌথ সভায় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিরসিত হতে পারে। জার্মানি ও ইতালিতে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত।

নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অনুসৃত হতে পারে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত দল-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হবে এবং তার ফলে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অধিকতর ভারসাম্য এবং সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সুগম হবে।

লক্ষণীয়, উপর্যুক্ত ধারায় ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’-এর গঠন জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ভারসাম্য সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে সব ক্ষমতা জাতীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত। জমিদার এমপিরা স্বীয় স্বার্থে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা খর্ব করার মাধ্যমে এই ভারসাম্য আরও প্রতিকূল করছেন।

স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন এই প্রবণতা প্রতিহত করবে। একটি ক্ষমতাবান স্থানীয় সরকার পরিষদের গঠন আনুপাতিক নির্বাচন দ্বারা গঠিত সংসদে সব এলাকার সমান হারে প্রতিনিধিত্বের অভাবসংক্রান্ত অভিযোগও প্রশমিত করবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা স্বীয় এলাকার জনগণের দাবিদাওয়া ও অভিমত জাতীয় অঙ্গনে প্রকাশের একটি বিকল্প ফোরাম পাবেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু বাজেট–সংক্রান্ত পরামর্শকমূলক ভূমিকার জন্য স্থানীয় সরকার পরিষদ সংবিধানের সংশোধন ছাড়াই গঠন করা যেতে পারে। পরবর্তী সময় কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশন গঠন–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার পরিষদকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে এবং সে পর্যায়ে এই পরিষদ আরও কী ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

এভাবে সংসদের নতুন কোনো কক্ষের সৃষ্টি না করেও আনুপাতিক এবং এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের সুফলের সমন্বয় সম্ভব হবে এবং তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুণগত ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে। এই সম্ভাবনার প্রতি রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

  • ড. নজরুল ইসলাম অধ্যাপক এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান