নদীভাঙনে কার লাভ, কার ক্ষতি

ভাঙনের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনফাইল ছবি

কুষ্টিয়া ও পাবনার মধ্যে বহমান পদ্মার কুষ্টিয়া–তীরবর্তী এলাকা ভাঙছে তো ভাঙছেই। পাঁচ বছর ধরে ভাঙন চলছে অবিরাম। ভাঙতে ভাঙতে নদী এখন কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী জাতীয় সড়ক পর্যন্ত চলে এসেছে।

কুষ্টিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মনে করছেন, পদ্মায় পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পানির স্রোত ধারালো হয়ে উঠছে। এর মধ্যেই নদীর গতিপথেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নদীশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করছেন, এতেই সমস্যার মাত্রা বেড়ে গেছে। আর মহাসড়ক পড়েছে বড় ধরনের ঝুঁকিতে।

ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরও ৩০ থেকে ৩৫ মিটার ভেঙে যাবে। তখন নদী থেকে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়কের দূরত্ব হবে বড়জোর ৩০ মিটার। বছর পাঁচেক আগেও এই সড়ক থেকে চার–পাঁচ কিলোমিটার পুবে না গেলে নদীর টিকিটিও দেখা যেত না।

সরেজমিন দেখা গেল, প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব এলাকায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে, সেসব এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ‘সান্ত্বনামূলক’ সমাধান খোঁজা হচ্ছে। গ্রামবাসী জানালেন, অনেক দিন থেকেই তাঁরা পাড় রক্ষার স্থায়ী সমাধানের (তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বাঁধ’ নির্মাণের) কথা শুনছেন। কিন্তু সে রকম কিছু এখনো দৃশ্যমান হয়নি। আশপাশের খোলা জায়গায় ইটের ব্লক তৈরি হচ্ছে। এগুলো নদীতে জিও ব্যাগের সহমরণে ইস্তেমাল হবে না গ্রোয়েন (বাঁধ) বাঁধা হবে, তা গ্রামবাসী দূরে থাক ঠিকাদারের লোকজনেরও জানা নেই।

একজন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রুস্তম আলী। তিনি বললেন, ‘গাঙ রোডের কূলে চলে আসায় এখন তোড়জোড় নাগিছে। আমার খেতখামার সব ফিনিশ।’

সংসদ সদস্যদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন গ্রামবাসী। মানববন্ধন, পাউবো অফিস ঘেরাও হয়েছে। সেসব নিয়ে নিউজ হয়েছে কিন্তু নদীকে কেউ থামাতে পারেনি অথবা চায়নি। বরাদ্দের জন্য স্থানীয় পানি বাবুদের লেখালেখির কথাও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু রুস্তম আলীদের যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। বললেন, ‘ঈশ্বরদী গিয়ে রিকশা চালানো ছাড়া আর কোনো দিশা নাই।’

কেন এমন ভাঙন

পাকশী প্রান্তে একতরফা নদীশাসন: আগস্ট (২০২২) হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন সেতু ‘হুমকির মুখে’ জাতীয় খবর একাধিক সংবাদপত্রে আর অনলাইনে ছাপা হতে থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিজের পাকশী প্রান্তের ২ নম্বর গার্ডার থেকে ৩ নম্বর গার্ডার পর্যন্ত চর নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ফন্দিবাজ অনেকে বলতে থাকেন, এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে নদী রক্ষা বাঁধ হুমকিতে পড়বে, সর্বনাশ হবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন সেতুর।

সেই সময় অবশ্য পাউবো ব্রিজ বা নদী রক্ষা বাঁধের ক্ষতির আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছিল। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার নাজিব কাওছার বলেছিলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পিলারের আশপাশের স্থানে চর নদীতে ভেঙে গেলেও ব্রিজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। 

চর ভাঙার খবরটিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ঠিকাদার চক্র পদ্মার পাকশী প্রান্তে নদীশাসনের পরিকল্পনা ও বরাদ্দ ম্যানেজ করে ফেলে। সেখানে প্রচুর জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়। পদ্মার পূর্ব তীরের একতরফা নদীশাসন পশ্চিম তীরকে ভাঙনপ্রবণ করে তোলে।

রূপপুরে পদ্মা নদী শাসন: রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রকে সুরক্ষা দিতে নদীর ঈশ্বরদী অংশে নদী শাসন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হক মনে করেন, ভেড়ামারার বিভিন্ন এলাকা এ কারণেই নদীভাঙনের কবলে পড়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০০ মিটারের গ্রোয়েন আছে নদীর মধ্যে। গ্রোয়েনের কারণে নদীর গতিপথে পরিবর্তন আসায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে।

অবৈধভাবে বালু উত্তোলন

ভাঙনের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য থামলেই নদীভাঙন অনেকটা কমে যাবে বলে স্থানীয় লোকজন মনে করেন। গত বছরের (২০২৩) ২৯ মার্চ বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পাবনার পাকশী পর্যন্ত পদ্মায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন।

পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেল যে এক শর বেশি জায়গায় নৌকায় বালু উত্তোলন চলছে। কোর্টের নিষেধাজ্ঞা যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের দাবি, পার্টির বালু তোলার বৈধ কাগজপত্র আছে। হাইকোর্টের নির্দেশের পর বালু উত্তোলনকারীরা একটি লিভ টু আপিল করে। সেই লিভ টু আপিলের কাগজকে স্থগিতাদেশ বলে চালিয়ে দিচ্ছে বালুখেকো। বলাবাহুল্য, লিভ টু আপিল গ্রহণ করার মানে এই না যে বালু তোলার অনুমতি বহাল থাকবে।

এর মধ্যে এক ‘প্যাঁচ’ লাগিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তারা বলেছে, ‘উন্নয়নকাজের জন্য বালু উত্তোলনের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। কিন্তু যেখানে হাইকোর্টের পরিষ্কার নির্দেশনা আছে, সেখানে বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? অথচ নৌ পুলিশদের ম্যানেজ করে উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে নদী থেকে বিরামহীন কায়দায় বালু ওঠানোর কারণে ভাঙন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।

কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়কের ও নদীর মাঝখানে মিরপুর উপজেলার মুন্সিপাড়া, সাহেবনগর, মির্জানগর ও রানাখড়িয়া এলাকা। চলতি মৌসুমে ইতিমধ্যে পানি বাড়ায় নতুন করে আরও ১৮৬ মিটার জমি নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। এর বেশির ভাগই ছিল তিন ফসলি জমি। গত ১২ অক্টোবর ২০২৪ থেকে পানি কমতে শুরু করলে ভাঙন আবারও তীব্র আকার ধারণ করে। বন্যানিয়ন্ত্রণ মাটির বেড়িবাঁধের প্রায় ৭২৮ মিটার পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ৬টি টাওয়ারের মধ্যে ৩টি টাওয়ার ভেঙে পড়ে। 

নদীর এক পারের ‘মূল্যবান’ স্থাপনা রক্ষার জন্য একতরফা নদীশাসন অন্য পারের মানুষের কান্নার কারণ হতে পারে। এটা আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে। রূপপুরের পারমাণবিক স্থাপনার পরিকল্পনায় নদীশাসনের সময় তার সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণেরও কার্যকর পদক্ষেপ রাখা উচিত ছিল। এমনটা রাস্তাঘাটের ক্ষেত্রেও বিবেচিত হওয়া উচিত। কুষ্টিয়া–ঈশ্বরদী সড়কের বেহাল অবস্থার অন্যতম কারণ রূপপুরের স্থাপনার জন্য অতি ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহন। সড়কগুলোর ভার বহনের ক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ ওজন এখন সামলাতে হচ্ছে এই সড়ককে। দিনের শেষে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাঁদের খাজনার টাকায় আমরা উন্নয়নের বাজনা বাজাই। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]