‘আমরা কোথায় গেলে একটু সাহায্য পাব, কোথায় গেলে আমাদের ঘর বাঁচাতে পারব, কোনো দিশা পাচ্ছি না। সবখানে কুকুর-বিড়ালের মতো হয়ে যাচ্ছি আমরা।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মিরনজিল্লা সিটি কলোনির ঘর হারানো ভুক্তভোগী পূজা রানী দাস।
সম্প্রতি বাংলাদেশের পুরান ঢাকার বংশালের আগাসাদেক রোডের পাশে মিরনজিল্লা হরিজন কলোনিতে উচ্ছেদের ঘটনা সবারই কমবেশি জানা। বুলডোজারের সামনে স্কুল পোশাক পরিহিত শিক্ষার্থীদের অবস্থান সত্যিই বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। সপ্তাহ দুয়েক হলো ভুক্তভোগী হরিজন হাজারো নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতার আহাজারিতে মিরনজিল্লার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। হাতজোড় করে সরকারের কাছে মাথা গোঁজার ঠাঁই চাওয়ার দৃশ্যটি বিশ্বমানবতাকে এক অসহায়ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়।
কতটা কষ্ট নিয়ে একজন মানুষ বলতে পারেন, ‘আমাদের চিড়িয়াখানায় ভরে রাখেন। অন্তত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মানুষ আমাদের দেখতে আসবে।’ এই আবেগগুলো ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
ভারতের নানা অঞ্চল থেকে আনা হয়েছিল এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়োনিষ্কাশন, চা-বাগান, রেলেরসহ বিভিন্ন কাজের জন্য। বলা হয়েছিল, তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে, সঙ্গে মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু কালক্রমে এখন বাংলাদেশের দলিত জনগোষ্ঠীর, বিশেষত হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ এমন একটি সংকটপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের লেশমাত্র নেই। ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা তাঁদের জন্য দুঃস্বপ্নের আরেক নাম। আর জাতপাতের বৈষম্যের কথা নাই-বা বললাম। তাঁরা সমাজের নিচুতলার মানুষ, অচ্ছুত, অস্পৃশ্য।
জাতপাতের নির্মমতা বুঝতে হলে হরিজনদের জীবন বুঝতে হবে। এখনো পরিচয় জানলে কেউ তাঁদের ঘরভাড়া দেন না। এমনকি রেস্তোরাঁ-হোটেলেও তাঁদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধারার সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসবে হরিজনদের নিমন্ত্রণ করা হয় না। অনেকটা বাধ্য হয়েই বংশপরম্পরায় পরিচ্ছন্নতার কাজের সঙ্গে যুক্ত এই সম্প্রদায়।
হরিজনের সন্তান হরিজনের কাজ করে জীবন কাটিয়ে দেবেন, যেন এমনটাই অলিখিত নিয়ম। এখন তো হরিজনদের চাকরিতে আউটসোর্সিং শুরু হয়ে গেছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যখন নিয়োগ হবে, তখন তাঁরা আর সিটি করপোরেশন কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কর্মচারী থাকবেন না। ফলে তাঁদের আবাসন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে শুভংকরের ফাঁকি থেকেই যাবে।
আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে শুধু হরিজনরাই কাজ করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে হরিজনের বাইরের সম্প্রদায়ের মানুষও এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। মজার বিষয় হলো, অহরিজনেরা তাঁদের চাকরি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিলেও, কাজটা করিয়ে নেন কোনো এক জাত-হরিজনকে দিয়েই। পরিচ্ছন্নতা কাজের বিনিময়ে নামমাত্র অর্থ হরিজনকে দিয়ে মোটা অঙ্কের বেতন নিজের পকেটে ভরার উদাহরণ ভরি ভরি।
বর্তমান মিরনজিল্লায় প্রায় ৪০০ বছর আগে হরিজনদের পূর্বপুরুষদের পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আনা হয়। তার পর থেকেই তাঁরা এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তাঁদের বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, এমনকি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট নম্বরসহ যাবতীয় নথিপত্রে উল্লেখমতে এই কলোনিই তাঁদের ঠিকানা। তারপরও কীভাবে তাঁদের অবৈধ বলা যায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
মিরনজিল্লা হরিজন কলোনির প্রবেশপথেই একটি স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। যেটি মূলত ১০ হরিজন শহীদের নামে করা। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর এখানকার দশজন হরিজনকে রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার কারণে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরও কেন তাঁদের স্বীকৃতি মেলেনি, তা এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। তবু প্রতিবছর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় অগ্রজদের স্মরণ করেন স্থানীয় হরিজনসহ মুক্তিকামী মানুষেরা।
হরিজন সূর্যসন্তান মহাবীর লাল সামুন্দ, নান্দু লাল, আনোয়ার লাল, ঈশ্বর লাল, খালবাল দাস, ঘাশিটা দাস, শংকর দাস হেলা, লালু দাস ও রামচরণরা এই দেশকে নিজের মনে করে জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হননি; কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কতটা শোভনীয়? জানি না এর উত্তর কী আর কেই-বা দেবেন?
‘মিরন বাই’ নামে একজন নামকরা বাইজি মূলত এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনিই এটা হরিজনদের দিয়ে যান। মূলত এটিই ‘মিরনজিল্লা’ নামকরণের পটভূমি। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এ কলোনির নিয়ন্ত্রণ যায় সিটি করপোরেশনের হাতে।
বর্তমান মিরনজিল্লায় প্রায় ৪০০ বছর আগে হরিজনদের পূর্বপুরুষদের পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আনা হয়। তার পর থেকেই তাঁরা এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তাঁদের বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, এমনকি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট নম্বরসহ যাবতীয় নথিপত্রে উল্লেখমতে এই কলোনিই তাঁদের ঠিকানা। তারপরও কীভাবে তাঁদের অবৈধ বলা যায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
মিরনজিল্লা হরিজন কলোনির শিকড় খুঁজতে গেলে অনেক আগে থেকেই শুরু করতে হবে। এর সঙ্গে হরিজন সেবক সমিতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা একটি সামাজিক সংগঠন। ১৯৪১ সালে এই মিরনজিল্লাতেই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা পায়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই জাত-হরিজনদের বাস এখানে।
১৮৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এটি ১৯৭৮ সালে সিটি করপোরেশনে পরিবর্তিত হয়। সেই থেকে আজ অবধি হরিজনেরা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতার কাজের সঙ্গে জড়িত। যাঁরা যুগের পর যুগ শহর সাফ (পরিষ্কার) করেছেন, আজ তাঁদেরই সাফ (নিশ্চিহ্ন) করে দেওয়া হচ্ছে।
সাত শতাধিক পরিবারের ১০ বাই ১০ ছোট্ট ঘরে তিন প্রজন্মের গাদাগাদি বাস এখানে। পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ—এমনকি নাতি-নাতনি নিয়ে একটি কক্ষে কীভাবে বাস করা সম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই চলছে হরিজনদের জীবন।
হরিজন সেবক সমিতি ৬ মে, ২০২২ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রের বরাবর একটি দরখাস্তের মাধ্যমে কলোনির মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখপূর্বক টিনের ঘরগুলো ভেঙে ১০ তলাবিশিষ্ট ৫টি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র ফজলে নূর তাপস ‘পর্যালোচনা করে পেশ করুন’ বলে স্বাক্ষর করলেও বিগত দুই বছরে পর্যালোচনার ফলাফল শূন্য।
আমরা দেখলাম, হরিজনদের উচ্ছেদ করার প্রতিই বরং মনোযোগ সিটি করপোরেশনের। কলোনিতে কিশোর গ্যাং এবং মাদকের আখড়া গড়ে ওঠার মিথ্যা অজুহাতও দেওয়া হয় উচ্ছেদের জন্য। ডিএসসিসিতে কর্মরত কেবল ৬৬ জনকে পুনর্বাসন করা হবে, বাকিদের উচ্ছেদ করে বাণিজ্যিকভাবে কাঁচাবাজার নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ঘর বরাদ্দ করা হলেও বাদবাকিদের দিকে তাকিয়ে চাবি নেননি তাঁরা। এই সহমর্মিতা সত্যিই শিক্ষণীয়।
ঢাকার যানজটের সমস্যা, অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, মশকনিধনসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো সমাধান দিতে না পারলেও অসহায় হরিজনদের উচ্ছেদে ডিএসসিসির আগ্রহের কমতি নেই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। যাঁরা ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাঁদের প্রতি এই নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ কেন? হরিজনেরা এক দিন নগর বা অফিস পরিষ্কার না করলে পরিস্থিতি কতটা দুঃসহ হবে, একবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছেন?
কলোনি উচ্ছেদের প্রথম দিনে (১০ জুন) উচ্ছেদে ভীত হয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় লক্ষ্মী রানীর। একইভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভবন দাস। ঘর উচ্ছেদ করায় ১১ জুন মনের কষ্টে প্রকাশ্যে নিমগাছে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান শাম্মী দাস। লক্ষ্মী রানীসহ নিহত ও আহত ব্যক্তিদের দায় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কীভাবে এড়াতে পারে? কলোনির পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যাহত হওয়ার দায় কে নেবে?
আশার খবর হলো, উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার ওপর ৩০ দিনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ১৩ জুন আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ২১ জুলাই এ বিষয়ে পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে। তাতে আপাতত হরিজনদের উচ্ছেদ করা যাবে না। খবরটি কিছুটা স্বস্তি দিলেও চিন্তামুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই মোটেও। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হরিজনদের আন্দোলন ছাড়া আর বিকল্প নেই।
মিরনজিল্লা উচ্ছেদের ঘটনা এখন আর স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানী ঢাকা পেরিয়ে গোটা দেশে এ নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল দলিত-হরিজন ঘরানার সংগঠনই নয়, বরং মূলধারার রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকারভিত্তিক এবং সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো প্রায় প্রতিদিনই এমন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। প্রকাশ করছে হরিজনদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি।
উচ্ছেদের ঘটনায় ৫৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের তাঁদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। উচ্ছেদের আগে তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু। সর্বশেষ ২০ জুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার দলিত-হরিজনের সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আমরা মনে করি, চট্টগ্রামের ব্যাটারি গলির রবিদাসপল্লি, রাজধানীর গোপীবাগ, ধলপুর, গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মসহ অগণিত উচ্ছেদ প্রক্রিয়া একই সূত্রে গাঁথা। সংগত কারণেই সবারই এগিয়ে আসা উচিত। এটি কেবল হরিজনদের সমস্যা নয়, বরং দেশের জাতীয় সমস্যা বিবেচনায় স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সময়ের দাবি।
আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে রেলের জমি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে রাজধানীর গোপীবাগ (টিটিপাড়া) ও ধলপুরের তেলেগু কলোনি উচ্ছেদ করা হয়। তবে সেখানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করা হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে মিরনজিল্লাতে, এমন আশঙ্কা হওয়া অমূলক নয়।
গত দেড় দশকে উন্নয়নের নাম করে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই উচ্ছেদগুলোর অভিজ্ঞতা জানান দেয়, এই জনস্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীভিত্তিক উন্নয়ন উচ্ছেদকৃত জনগণকে কেবল নিঃস্ব করেছে। মিরনজিল্লা সুইপার কলোনিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সময়ে গৃহহীনদের গৃহ উপহার দিচ্ছেন, সে সময়ে দেশের সেবাদানকারী হরিজন জনগোষ্ঠী গৃহহীন হবে কেন? পরিশেষে ভুক্তভোগী হরিজনদের সঙ্গে সুর মিলিয়েই বলতে চাই, ‘হরিজনেরা কি মানুষ নন? এ দেশের নাগরিক নন? রোহিঙ্গাদের যদি জায়গা হয়, তবে ৪০০ বছর ধরে সেবা দিয়েও হরিজনেরা কেন উচ্ছেদের শিকার হবেন?’
শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ সহসাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), কেন্দ্রীয় কমিটি।