বাংলাদেশকে কি একটি আধুনিক রাষ্ট্র বানানো সম্ভব

আধুনিক রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়? সংক্ষেপে যদি বলি, রাষ্ট্রের যেসব চারিত্র্য লাভের জন্য ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল, সেগুলো যে রাষ্ট্রে থাকবে, সেই রাষ্ট্রই আধুনিক রাষ্ট্র। সর্বপ্রথম যে বৈশিষ্ট্য, তা হলো রাষ্ট্র চলবে মানুষের তৈরি আইনের দ্বারা—রাজার তৈরি আইন দিয়ে নয়। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিকসের তত্ত্ব অনুসারে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্বের সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যায়—পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জিনও। অতএব কোনো আইনই অনন্তকাল চলতে পারে না। নতুন সময়ে প্রণীত হতে হবে নতুন আইন। পরিবর্তনকে মেনে নেওয়াই আধুনিকতা।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্ট পুরো পশ্চিমা দুনিয়ায় যে বিশ্ববীক্ষা তৈরি করেছিল, তার মূলকথা ছিল বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির আশ্রয়, ভাবের বিপরীতে বস্তুর প্রাধান্য। এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টই ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি। অতএব এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের পরিভাষার কয়েকটি শব্দবন্ধ লক্ষ করলে আধুনিক রাষ্ট্র বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। যেমন এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আছে যুক্তির মহিমা উদ্‌যাপন ও যুক্তির প্রয়োগ; বিশ্বাস ও পূর্বধারণা থেকে মুক্তি; যে ধীশক্তি দিয়ে মানুষ এই অনন্ত বিশ্বকে জানতে পারে ও মানবসমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে, সেই শক্তির উন্মেষ ঘটানো; জ্ঞান, মুক্তি ও সুখ হলো যুক্তিবাদী মানবতার লক্ষ্য ইত্যাদি।

‘যুক্তিবাদী মানবতা’ পরিভাষাটি একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন, ‘প্রত্যাদেশ’ বলছে, নিম্নবর্ণকে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। তখন চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী কেউ একজন হয়তো বলে বসবেন, ‘না। এটা হতে পারে না। ঈশ্বর এমন বৈষম্য করতে পারেন না। অতএব এই প্রত্যাদেশ ঈশ্বরের বাণী নয়। এটা নিছক কায়েমি স্বার্থবাদী ব্রাহ্মণদের কারসাজি।’

বাংলাদেশের সমাজে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চার খরা চলছে, তখন ফরাসি বিপ্লবের পূর্বক্ষণে জনগণের প্রস্তুতির পর্বটি খেয়াল করুন। ভল্‌তেয়ার, রুশোসহ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে কালের অগ্রবর্তী চিন্তাবিদদের এবং লেখকদের একটি দল ব্যাপকভাবে লেখালিখি শুরু করেন। এগুলো ছিল রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, মহাবিশ্ব, মানুষ, ঈশ্বর ইত্যাদি সম্পর্কিত দার্শনিক চিন্তা। এই দর্শনে ছিল মানবিক যুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব। আর ছিল প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ও বিরাজমান রাজনৈতিক অনুশীলনের সমালোচনা। ফ্রান্সের জনগণ তাঁদের এই দর্শন ব্যাপকভাবে পাঠ করে, গ্রহণ করে এবং ঘোরতর পরিবর্তন সাধনের জন্য সর্বাত্মক বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়।

ফরাসি বিপ্লবের শিকড় প্রোথিত চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকে ঘটা ইউরোপের রেনেসাঁসের গভীরে। আর রেনেসাঁস হলো ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্জন্ম। রেনেসাঁ ধ্রুপদি দর্শনশাস্ত্রের, সাহিত্যের ও শিল্পের পুনারাবিষ্কার। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বিরাজমান অন্ধকার যুগ পার হয়ে এই যে পুনরাবিষ্কার, কী সেই পুনরাবিষ্কার? পুনরাবিষ্কারটা হলো এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে মানুষ, মানুষের সব কর্মের কেন্দ্রে থাকবে মানুষ; জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে মানুষের যে অর্জন—সব মানুষের জন্য, এই মাটির পৃথিবীতে তাঁদের জীবনমানের উন্নতির জন্য।

ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ডেও ঘটে গেল অনেক কিছু এবং বিরাট কিছু। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ইংল্যান্ডে ঘটাল শিল্পবিপ্লব। সেই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপের অন্য দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে নগরায়ণ হলো, যাতায়াতব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটল। শ্রমিকের জীবনমানের উল্লম্ফন হলো। এরপর নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা, রাজার ওপর পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব, রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করাসংক্রান্ত বিল অব রাইটস (১৬৮৯) পাস হলো এবং গ্লোরিয়াস রেভল্যুশন (১৬৮৮-১৬৮৯) ঘটল।

ইংলিশ বিল অব রাইটসের অনুপ্রেরণায় যুক্তরাষ্ট্রেও ১৭৮৯ সালে পাস হলো বিল অব রাইটস। যার মধ্যে মানুষের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে, যেমন বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদপত্র, সমাবেশ এবং ধর্মের অনুশীলনের নিশ্চয়তা; ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়া এবং অস্ত্র বহন করার অধিকার এবং যে ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের কাছে অর্পিত নয়, তা রাজ্য ও জনগণের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

১৭৯২ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব পূর্ণতা লাভ করে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আর বিনাশ হয় যেকোনো রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ধর্মের ভূমিকা। প্রতিষ্ঠিত হয় ফরাসি বিপ্লবের তিন আদর্শ: সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব। সমগ্র পৃথিবীতেই শুরু এক নতুন যুগের। ফরাসি বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় কত দেশে কত যে মানুষ স্বাধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে এবং বিজয়ী হয়ে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

এতক্ষণ যেসব বিপ্লবের ও মানুষের স্বাধিকার অর্জনের গল্প বলা হলো, তার সঙ্গে সর্বশেষ বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্য সব বিপ্লব মানুষে মানুষে সাম্য নিশ্চিত করেনি। ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, নিজের মতো করে জীবনযাপনের অধিকার ইত্যাদির সঙ্গে ভাতের অধিকার তথা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য পাওনা রুশ বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো বিপ্লব নিশ্চিত করতে পারেনি। বস্তুত, পিছিয়ে পড়া মানুষ তথা নারীর ও শ্রমিকের মুক্তি ছাড়া মানুষের মুক্তি হয় না। এই মুক্তি সাম্যবাদী আদর্শের বাস্তবায়ন ছাড়া অসম্ভব। কারণ, একমাত্র সাম্যবাদী আদর্শের ভিত্তিতে নির্মিত রাষ্ট্রেই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে শ্রমজীবী মানুষ—সে পুরুষ কিংবা নারী হোক। প্রমাণ তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন।

রুশ বিপ্লবের অমর সৃষ্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিস্ময়কর অগ্রগতি এবং একটি পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ছাড়াও উন্নয়নের মৌলিক দুটি উপাদান সাক্ষরতায় ও নারীর ক্ষমতায়নে দেশটি যা করেছে, তা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো। ১৯১৭-এ বলশেভিক সরকার গঠনের পর ১৯৩৯ সাল নাগাদ শহর ও গ্রামে শিক্ষার হার যথাক্রমে ৯৪ ও ৮৬-তে উন্নীত হয়, যা ১৯৫৯ সাল নাগাদ হয় ৯৯ ও ৯৮, যেখানে ১৮৯৭ সালের রাশিয়ার সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী নামমাত্র সাক্ষরতার হার ছিল ২১ শতাংশের নিচে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষে সমতা আনতেও পুরোপুরি সক্ষম হয়। ইতিহাসবিদ বেন একলফ মন্তব্য করেন, ‘ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির যা করতে লেগেছে কমপক্ষে ১০০ বছর, সোভিয়েত ইউনিয়ন তা করেছে মাত্র ২২ বছরে।’

পুঁজিবাদী বিশ্বে নারী স্বাধীনতা, আমার মতে একটি আলংকারিক স্লোগানমাত্র। এর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল গণ্য করে একধরনের ভাবালুতার ডুবে যেতে পছন্দ করেন। একজন পুঁজিবাদী নারী স্বাধীনতার চর্চা করতে পারেন না, কারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতার চর্চা ছাড়া আলাদাভাবে নারী স্বাধীনতার চর্চা করা যায় না। রাষ্ট্রে, সমাজে ও পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে, অর্থনৈতিক সক্ষমতায় ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় নারী-পুরুষের সমান হতে পারে একমাত্র সাম্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে। অতএব, কেউ যদি নারী স্বাধীনতার চর্চা করতে চান, তাঁকে সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে।

পুঁজিবাদী বিশ্বের শিরোমণি যুক্তরাষ্ট্রে একই কাজ করে পুরুষের চেয়ে নারীরা, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা কম মাইনে পান। মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের, পুরুষের চেয়ে নারীর অনেক বেশি। কারণ, বছরের পর বছর কৃষ্ণাঙ্গরা, নারীরা ক্যালোরি–স্বল্পতায় ভোগার কারণে দেহে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে হলিউড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা উচ্চপদস্থদের দ্বারা, শিক্ষকদের দ্বারা নারীদের যৌন হয়রানির ও ধর্ষণের ঘটনা নিরন্তর ঘটে যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ‘সাম্য’ এখনো একটি ফাঁকা বুলি হিসেবে রয়ে গেছে।

আমাদের ছাত্ররা যদি একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায়, তাহলে তাদের ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পাঠ করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে এবং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়তে হবে। আর যদি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে ফরাসি বিপ্লব পার হয়ে হেঁটে যেতে হবে আরও দূরে—পূর্ব দিকে, রুশ বিপ্লবের কাছে।

  • এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]