মোগল সম্রাট নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খান বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে ঢাকায় সরিয়ে আনেন। ঢাকার নাম হয় জাহাঙ্গীরনগর। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে লালবাগে তৈরি হয় কিল্লা তথা সেনানিবাস। সেখান থেকে দ্রুত আক্রমণ কিংবা পশ্চাদপসরণের জন্য নদীর তীর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ বা টানেল তৈরি করা হয়েছিল।
তাঁর মানে বাংলাদেশ সতেরো শতকেই প্রবেশ করেছিল টানেল যুগে। প্রায় সাড়ে চার শ বছর পর তৈরি হলো কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল। এর উদ্বোধন হলো গতকাল। তবে এর প্রধান উদ্দেশ্য সামরিক নয়। এটি করা হয়েছে সড়ক যোগাযোগের অংশ হিসেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাহাড়ের নিচ দিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই রেলওয়ে টানেল তৈরি করেছিল। তবে নদীর নিচ দিয়ে এ অঞ্চলে এটাই প্রথম। টাকা দিয়েছে বাংলার জনগণ। তৈরি করে দিয়েছে চীনা ঠিকাদার। প্রযোজনা করেছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রী টোল দিয়ে টানেল পেরিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এটি ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রচারেরই অংশ। নিয়মিত বিরতিতে তিনি এখানে-সেখানে নানা মেগা স্থাপনা উদ্বোধন করে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরে। আগামী নির্বাচনে এসব থেকে তিনি যথেষ্ট মাইলেজ পাবেন বলে মনে করা হয়।
কর্ণফুলীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল আমাদের দেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এক টেলিভিশন সংবাদ পাঠক এটাকে বলেছেন পাতাল বিজয়। এর আগে আমাদের হয়েছিল সমুদ্র বিজয়। কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলে সেটি উদ্যাপনের উৎসব যথাযথভাবে হতে পারল না। সবার নজর ছিল ঢাকায় ডাকা কয়েকটি রাজনৈতিক সমাবেশ।
২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে ‘মহাসমাবেশ’ ডেকেছিল বিএনপি। এটা অনুমিতই ছিল, আওয়ামী লীগ মাঠ ছেড়ে দেবে না। এটা তো ইজ্জতের লড়াই! লীগ শান্তিবাদী ও শান্তিপ্রিয় দল। তারা ডাকল শান্তি সমাবেশ, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে, যা এত দিন ছিল জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব অঞ্চল। এটি আপাতত আওয়ামী লীগের দখলে। জামায়াতে ইসলামীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মতিঝিলের একটি সড়ক।
জামায়াত অনেক দিন ধরেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল নিজেদের দৃশ্যমান করার। দলটি নির্বাচন কমিশনে স্বনামে নিবন্ধন পায়নি। এর অর্থ হলো তারা কোনো দলীয় মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। দলটি কিন্তু নিষিদ্ধ নয়। দলীয় সমাবেশ তারা করতেই পারে। সরকারের সঙ্গে তাদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সমাবেশ করার জন্য তারা সবুজ সংকেত পেয়েছে। এবারের সমাবেশ নেপথ্যের লেনদেনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর পেছনেও খেলা থাকতে পারে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৯২-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে। তখন ছিল সংবিধান বদলে ফেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
রাস্তা আটকে মিছিল-সমাবেশ করা গণতান্ত্রিক অধিকার! তো সরকার এবং সরকারবিরোধীরা মিলেঝুলেই কাজটি করছে। ফলে ঢাকা অচল হয়ে পড়েছে। গতকাল রাস্তায় যান চলাচল ছিল অস্বাভাবিক রকম কম। অনেক মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বের হননি।
এর মধ্যে শুরু হলো নতুন উপদ্রব। বিএনপির ‘অহিংস’ আন্দোলনের কি এখানেই যতি? মানুষ হরতাল চায় না। হরতাল ‘সফল’ করাতে হলে অনেক ঘটনা ঘটাতে হয়। এটা বিএনপির জন্য শুভ হবে না। তা ছাড়া পুলিশ আরও হার্ডলাইনে যাবে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথায় সে রকমই মনে হচ্ছে। দেশ গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটা বড় রকমের বিপর্যয় হোক, আমরা কেউ তা চাই না। কিন্তু আমরা তো কেবল একটা সংখ্যা। পলিটিকসের নাটাই তো অন্যদের হাতে!
সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও এ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয় নিজ উদ্যোগে কিংবা বেসরকারি খাতে। তঁাদের অনেকেরই রুটি-রুজির পথ এক দিনের জন্য হলেও বন্ধ। তারপরও এর ফল যদি ভালো হয়, সবাই খুশিমনে এটা মেনে নেবেন। তবে সে রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সবাই মিলে একজোট হয়ে সবকিছু অচল করে দিয়েছিল আমাদের ইতিহাসে একবারই, একাত্তরের মার্চে। তখন সবার লক্ষ্যও ছিল এক। এখন যুযুধান দলগুলোর লক্ষ্য কিংবা মতলব আলাদা। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার। বিএনপির গতকালের সমাবেশটি ছিল একটি ‘ক্রিয়া’। আওয়ামী লীগেরটি ছিল ‘প্রতিক্রিয়া’।
মাঠের বড় খেলোয়াড় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। একটি পক্ষ মাঠে নেমেছে নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে কিংবা ডিঙিয়ে। অন্য পক্ষ সরকারের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা পাচ্ছে পুরোপুরি। মানুষ সবই দেখছে এবং শুনছে। রাজনীতিতে তাদের মধ্যে ফারাক থাকলেও রাজনৈতিক আচরণে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। ক্ষমতায় থাকলে এটা বোঝা যায়। এখন দুটি দলই ক্ষমতার প্রত্যাশী। একটি দল ক্ষমতায় যেতে চায়। অন্যটি ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। রাষ্ট্রযন্ত্র যার পক্ষে থাকবে, তারই জিত হবে। নাগরিকেরা এর চেয়ে বেশি আশা করলে ঠকবে।
বিএনপি কী চায়? মুখে বলছে, তারা চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটা অবাধ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এটা চায় না। কেননা, সংবিধানে এটা নেই। মনে হয়, আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে কস্মিনকালেও সংবিধান বদলায়নি। মোদ্দাকথা হচ্ছে, যার যেটায় সুবিধা, সেটাই করবে। কেউ আত্মহত্যা করতে চায় না। সুতরাং এখানে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ক্যামেরার কারিকুরিতে অনেক সময় সমাবেশের আকার বোঝা যায় না। তারপরও ঠাওর করা যায়, সমাবেশ কেমন হয়েছিল বা হতে পারত। কিন্তু পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সমাবেশ হতে পারেনি। তার আগেই বেঁধে গেছে হট্টগোল। জনতা তেতে ছিল। উর্দিধারী পুলিশ লাঠি-ঢাল নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। একটা পর্যায়ে এসে অগ্ন্যুৎপাত ঠেকানো গেল না। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া এবং পরিশেষে মব ভায়োলেন্সে যা হয় আরকি—আগুন লাগানো, গাড়ি পোড়ানো। সে একই চিত্রনাট্য! সমাবেশ শুরুর আগেই সব ছত্রখান। যাঁরা দলের অতটা সিরিয়াস কর্মী-সমর্থক নন, কিন্তু কৌতূহলবশে সেখানে যেতে চেয়েছিলেন, তাঁরা আর যাননি। ফলে বিএনপি যেমনটি আশা করেছিল, তেমনটি হয়নি। এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে।
বিএনপি-পুলিশ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছে একে অন্যের বিরুদ্ধে। এখন বিএনপির কপালে আবারও আগুন-সন্ত্রাসীর তিলক লাগবে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি জেনেবুঝে কেন এমনটা করবে? এর আগে তারা দেশজুড়ে নানা জায়গায় অনেকগুলো বড় সমাবেশ করেছে। কোথাও তো এমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এবার কেন হলো? এটা কি তারা ইচ্ছা করে করেছে? করলে তাদের কী লাভ? নাকি এখানে আরও কোনো পক্ষ আছে, জল ঘোলা হলে যাদের মাছ শিকারে সুবিধা হয়?
আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশেও শান্তি বজায় থাকেনি। সেখানেও নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ছোঁয়া দেখা গেছে। এসব উসকানি কারা দেয়? কেন দেয়?
মাঝখানে পড়ে এক পুলিশ সদস্যের প্রাণ গেল। রোববার হরতালের ঘোষণা এল। একবার ছন্দপতন হলে তার জের থাকে বেশ কিছুদিন। তো জিত হলো কার?
২৮ অক্টোবর তো শেষ নয়। বলা যায় শেষের শুরু। আগামী জানুয়ারির পয়লা সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন হবে বলে কথাবার্তা হচ্ছে। এখন যেভাবে মাঠ গরম হচ্ছে, তা দিন দিন আরও তেতে উঠবে। নির্বাচন এলেই এ রকম একটা অবস্থা তৈরি হয়। দ্রব্যমূল্যের উত্তাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি যত সাংঘর্ষিক হবে, জনশৃঙ্খলা ততই হুমকির মধ্যে পড়বে। তার তাপ এসে লাগবে বাজারে। যাদের ছেলেমেয়েরা দেশেই পড়ে আছে, তাদের পড়াশোনা লাটে উঠবে। মানুষের আয়রোজগারের পথ সংকুচিত হবে। দুর্দশার সীমা থাকবে না।
এর মধ্যে শুরু হলো নতুন উপদ্রব। বিএনপির ‘অহিংস’ আন্দোলনের কি এখানেই যতি? মানুষ হরতাল চায় না। হরতাল ‘সফল’ করাতে হলে অনেক ঘটনা ঘটাতে হয়। এটা বিএনপির জন্য শুভ হবে না। তা ছাড়া পুলিশ আরও হার্ডলাইনে যাবে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথায় সে রকমই মনে হচ্ছে। দেশ গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটা বড় রকমের বিপর্যয় হোক, আমরা কেউ তা চাই না। কিন্তু আমরা তো কেবল একটা সংখ্যা। পলিটিকসের নাটাই তো অন্যদের হাতে!
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক