ট্রাম্পের সমর্থকেরা কোন গণতন্ত্র চান

ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রায় সবাই একমত যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের টিভি বিতর্কে জো বাইডেনের বিপর্যয়কর পারফরম্যান্স আগামী নভেম্বরের ভোটে ডোনাল্ড ট্রাম্প, তথা রিপাবলিকান পার্টির জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।

ওই বিতর্কে ট্রাম্প অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং বারবার ক্ষেপে যাচ্ছিলেন; কিন্তু তিনি তা করছিলেন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। এসব মিথ্যা বলার সময় তিনি সাবলীল ও দৃঢ় ছিলেন।

অন্যদিকে বাইডেন বেশ কিছু ভালো পয়েন্ট উল্লেখ করেছিলেন; কিন্তু তাঁকে কথা বলার সময় উদ্‌ভ্রান্ত বৃদ্ধের মতো মনে হচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত বাইডেনের ভালো পয়েন্টের মূল্যায়ন হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য হালকা কথা বলেই দর্শকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচনী রাজনীতির ঝানু কৌশলবিদ ফ্রাঙ্ক লুন্টজ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি নিবন্ধে লিখেছেন, বাইডেন ও ট্রাম্প কী নীতি গ্রহণ করেছেন বা কোন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন, সেটি ভোটারদের কাছে খুব একটা মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। তাঁরা ভোটারদের মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি তৈরি করতে পারছেন, সেটি এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই, টিভি বিতর্কে বাইডেনের এই বিপর্যয় দেখার পর ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন, ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুন

স্বাধীন বিচার বিভাগ, মুক্ত গণমাধ্যম ও একটি নির্দলীয় সরকারি আমলাতন্ত্র ছাড়া একটি উদার গণতন্ত্র চলতে পারে না। বাইডেন এই মূল গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলোতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ট্রাম্প ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন, তিনি প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের সব জায়গা নিজের অনুগতদের দিয়ে ভরে ফেলার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি আদালত এবং বিচার বিভাগকে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান। তিনি গণমাধ্যমকে ঘৃণা করেন। তিনি উন্মত্ত জনতাকে সহিংসতার জন্য উসকানি দিয়ে থাকেন।

সুতরাং ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ান (আমি নিজে বিশ্বাস করি তিনি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি), তাহলে যে আমেরিকানরা তাঁদের সরকারব্যবস্থার প্রতি যত্নশীল, তাঁরা অবশ্যই ট্রাম্পের মতো একজন কর্তৃত্ববাদীর চেয়ে বাইডেনের মতো একজন বৃদ্ধ গণতন্ত্রীকেই বেশি পছন্দ করবেন।

সমস্যা হলো, এখন বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরে গেলেও, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ধ্বংসাত্মক প্রশাসনের বিপদ আগের মতোই জোরালো অবস্থায় থেকে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন বহু লোক রয়েছেন, যাঁরা ট্রাম্পের হিংসাত্মক মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, আমেরিকার গণতন্ত্র স্বার্থপর অভিজাত লোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা। তাঁরা মনে করেন, এই অভিজাত গোষ্ঠী গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষের সেবা করার ভান করে।

‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের’ একটি উদাহরণ হলো ফ্যাসিবাদ। ‘নেতার সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত’, এই তত্ত্ব নাৎসি জার্মানি এবং মুসোলিনির ইতালিতে জনপ্রিয় হয়েছিল। কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও এটি গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হয়েছিল। কারণ, এই ব্যবস্থায় নেতা হলেন জনগণের প্রত্যক্ষ এবং একমাত্র প্রতিনিধি। প্রকৃত অর্থে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে।

লাল মাগা টুপি (ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানকে সংক্ষেপে ‘মাগা’ বলা হয়) পরে ট্রাম্পের সমাবেশে যোগ দেওয়া মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এ ধরনের অনুভূতি আগে থেকেই ছিল; কিন্তু কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনের পাশাপাশি বাইডেন সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট তরুণ ভোটাররাও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে শুরু করেছেন।

তাঁদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি ডেমোক্র্যাটরা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁরা প্রতারিত বোধ করছিলেন।

আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, দোদুল্যমান ভোটার অধ্যুষিত রাজ্য বা সুইং স্টেটগুলোর আমেরিকানরা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামান। সেই জরিপে বলা হচ্ছে, ওই অঙ্গরাজ্যগুলোর ৬১ শতাংশ নাগরিকের কাছে মার্কিন গণতন্ত্রের হুমকিতে পড়া অত্যন্ত গুরুতর বিষয়।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই রাজ্যগুলোর ৪৪ শতাংশ ভোটার বিশ্বাস করেন, মার্কিন গণতন্ত্রের ওপর আসা যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় ট্রাম্প অন্যদের চাইতে ভালো করবেন। আর সেখানকার মাত্র ৩৩ শতাংশ ভোটার মনে করেন, এই কাজে বাইডেন ভালো করবেন।

এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই জনগণ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

একটি যথার্থ সক্রিয় উদার গণতন্ত্রে ভোটাররা সেই সব রাজনীতিবিদকে নির্বাচিত করেন, যাঁরা ভোটারদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।

আরও পড়ুন

এ ধরনের গণতন্ত্রে বিজয়ী প্রার্থীরা শাসন করার অধিকার পান, কিন্তু স্বৈরশাসকের মতো যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না; অর্থাৎ এ ধরনের গণতন্ত্রে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের সেই সব ভোটারেরও কল্যাণ নিয়ে ভাবতে হয়, যাঁরা হেরে যাওয়া দলগুলোকে ভোট দিয়েছিলেন বা ভোটই দেননি। যেকোনো বিরোধপূর্ণ বিষয় বিতর্ক ও সমঝোতার মাধ্যমে তাঁদের সমাধান করতে হয়।

বাইডেন পুরোনো নীতির অনুসারী। তিনি আলোচনায় বিশ্বাস করেন। তিনি সম্ভাষণমূলকভাবে পিঠ চাপড়ে দিতে, কানে ফিসফিস করে বাঘ বিনিময় করতে এবং কোনো ধরনের চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনে হাত মুচড়ে দিতেও প্রস্তুত থাকেন।

গণতন্ত্র সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করা লোকেদের কাছে মনে হতে পারে, দুর্নীতিবাজ অভিজাতেরা এভাবেই তাঁদের স্বার্থ হাসিল করেন।

তাঁরা মনে করতে থাকেন, এই রাজনীতিকদের কাছ থেকে জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। তাঁরা মনে করেন, এই রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না এবং প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন না। তাঁরা মনে করেন, বাইডেনের মতো রাজনীতিকদের পক্ষে আমূল পরিবর্তন অসম্ভব।

তাঁরা যা চান তা হলো, ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র;, যেখানে একজন শক্তিশালী নেতা কংগ্রেসের স্বার্থপর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মতির অপেক্ষা না করেই একক দায়িত্বে জনগণের পক্ষে কথা বলবেন।

এই ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের’ একটি উদাহরণ হলো ফ্যাসিবাদ। ‘নেতার সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত’, এই তত্ত্ব নাৎসি জার্মানি এবং মুসোলিনির ইতালিতে জনপ্রিয় হয়েছিল। কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও এটি গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হয়েছিল। কারণ, এই ব্যবস্থায় নেতা হলেন জনগণের প্রত্যক্ষ এবং একমাত্র প্রতিনিধি। প্রকৃত অর্থে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে ভোটাররা গণতন্ত্রের ত্রাতা বলে মনে করেন তাঁদের মতে, বাইডেন বা ডেমোক্র্যাটরা প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক নন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ডেমোক্র্যাটদের কারণে ভিন্ন ধর্মবর্ণের অভিবাসীরা এসে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করে ফেলছেন। অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকেরা লিঙ্গ, বর্ণ ও যৌনতা-সম্পর্কিত ধারণা বদলে দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, বাইডেন প্রশাসন অভিজাত কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে এই অভিবাসীদের জায়গা করে দিচ্ছে।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই ভোটাররা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে উদার গণতন্ত্রের স্থলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

তাঁদের এই বিশ্বাসই উদার গণতন্ত্রীদের জন্য সবচেয়ে চিন্তার বিষয়।

  • ইয়ান বুরুমা ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও গবেষক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ