পরাজিত হলেও যে পুরস্কার জোটে, তার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন মো. আজমত উল্লা খান। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাকে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এবারের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা হেরে যান রাজনীতিতে একেবারে অনভিজ্ঞ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে। তাঁর মেয়র হওয়ার পেছনে প্রথমত তিনটি ফ্যাক্টর কাজ করেছে। এক. নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি।
ভোট সুষ্ঠু হলেও সামগ্রিকভাবে ভোটের হার ছিল ৫০ শতাংশের মতো। পরিবেশ সুষ্ঠু থাকায় যাঁরা ভোট দিতে গেছেন, তাঁরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় ক্ষমতাসীনদের প্রতি জন-অনীহা বাড়ায় সরকারদলীয় প্রার্থী ভোটার আকর্ষণ করতে পারেননি। বরং বিরোধী ভোট প্রতিদ্বন্দ্বী জায়েদা খাতুনের পক্ষে পড়েছে। তৃতীয়ত, জায়েদা খাতুন বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা।
আগের নির্বাচনে প্রশাসনের সহায়তা ও কারসাজিতে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁর অপসারণের বিষয়টি ভালোভাবে নেননি ভোটাররা। এবারের নির্বাচনে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার বিষয়টিকেও উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। এটিও ভোটারদের একাংশের মধ্যে, বিশেষ করে নারী ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে জায়েদা খাতুনের প্রতি সমবেদনা তৈরিতে কাজ করে। জাহাঙ্গীর আলমই মূলত তাঁর মা জায়েদা খাতুনের হয়ে প্রচারে অংশ নেন। বলা চলে, ছেলে জাহাঙ্গীরের ছায়া প্রার্থী হিসেবে মেয়র হয়েছেন জায়েদা।
আয়তনের দিক থেকে গাজীপুর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন হলেও এটি অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল এক নগর। নির্মীয়মাণ এই নগরটিতে এমন একজন মেয়র নির্বাচিত হলেন, যাঁর মেয়রের চেয়ারে বসা ছাড়া নীতিনির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা কম। ফলে এই সিটি করপোরেশন বাস্তবে আধা ক্রিয়াশীল অবস্থায় থাকার ঝুঁকি বেশি। তাতে শেষ পর্যন্ত ভোগান্তিতে পড়বেন সাধারণ নাগরিকেরা।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে অতি লাভজনক ব্যবসা, সেখানে ক্ষমতাসীন দলে নেতা উপচে পড়াটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দল তাদের কোনো নেতাকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করতেই পারে। কিন্তু সরকারি সংস্থায় তাদের পুনর্বাসিত করা কতটা নৈতিক? প্রতি মাসে তাঁদের বেতন, সম্মানী ভাতা দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যায়। ভ্যাট, আয়কর কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের মাধ্যমে সেই টাকাটার জোগান নাগরিককেই দিতে হয়।
পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা। ২০০৯ সাল-পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের যে সাবেকি ধারা, সেই ধারার একজন নেতা। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগে যে নতুন ধারার (মূলত ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, নানা পেশাজীবী ও সুযোগসন্ধানীদের ক্লাব) উত্থান ঘটেছে, সেই রাজনীতিতে নিজ দলে তিনি অনেকটা বেমানান হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি হেরে যান বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নানের কাছে। ফলে জায়েদা খাতুনের কাছে পরাজয়টাই তাঁর প্রথম পরাজয় নয়।
গাজীপুর সিটিতে আজমতের হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য একটা বড় ধাক্কা। দলের নেতা-কর্মীদের মনোবলে যাতে চিড় না ধরে, সে কারণে আজমতকে পুনর্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আজমত উল্লা।
আজমত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন ভোটে তাঁর পরাজয়ের শাস্তিটা কি গাজীপুরের নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? নগর-পরিকল্পনা ও নগর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গণপূর্তের একটা সংস্থার শীর্ষে পদে কেন এমন একজনকে বসানো হলো, যঁার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো কারিগরি ধারণা নেই। এই রাজনৈতিক পুরস্কারের কারণ আসলে কী?
একদিকে ‘ছায়া মেয়র’ আর অন্যদিকে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পরাজিত প্রার্থী। এই বাস্তবতায় গাজীপুরে সুষ্ঠুভাবে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব? গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আজমত উল্লা, সেটা শোনার পর জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য ছিল, ‘এটি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছু নয়।’ এ বক্তব্য থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে গাজীপুর সিটির নাগরিকদের ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে চলেছে।
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে রাজনৈতিক নিয়োগ এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এই কর্তৃপক্ষের বিরোধের পরিণতি যে কতটা দুর্বিষহ হতে পারে, তার একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত হলো চট্টগ্রাম মহানগর। সেখানে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সরকারি দুই সংস্থার দ্বন্দ্বের বলি হতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিককে। সড়কে হাঁটতে গিয়ে বাবার হাত থেকে ছিটকে খালে পড়ে সন্তানের মৃত্যুও সেখানে ঘটেছে। অথচ কেউ কোনো দায় নেয় না। একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়েই দায়িত্ব শেষ করে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে যখন মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই সময়ে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন আবদুচ ছালাম। সে সময় উড়ালসড়কসহ অনেক উন্নয়নকাজ সিটি করপোরেশনকে না দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা গিয়েছিল। সেই দ্বন্দ্বের জের এখনো বহন করতে হচ্ছে। গাজীপুরে সেটি হওয়ার আশঙ্কা আরও বেশি।
চট্টগ্রামে আবদুচ ছালাম সিটি মেয়র পদে নির্বাচন করেননি। দলের মনোনয়নবঞ্চিত থাকার পুরস্কার হিসেবে এই পদে বসানো হয়েছিল। প্রায় এক দশক ধরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন আবদুচ ছালাম। আ জ ম নাছির উদ্দিন যখন মেয়র তখনও চট্টগ্রাম সিটি করপােরেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাপান–উতোর অব্যাহত ছিল।
গাজীপুরে যেহেতু আজমত উল্লা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছেন, সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তেমন কিছু হলে এর প্রভাব পড়বে উন্নয়নকাজে।
চট্টগ্রামে বাজে দৃষ্টান্ত থাকার পরও কেন গাজীপুরে সেই একই পুনরাবৃত্তি ঘটল?
ক্ষমতাসীনদের তরফে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কিংবা গুরুত্বহীন স্থানীয় সরকারে বয়স্ক, পরাজিত ও বিদ্রোহী নেতা পুনর্বাসনের নানা প্রক্রিয়া চলছেই। জেলা পরিষদ হয়ে উঠেছে এ ধরনের নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে অতি লাভজনক ব্যবসা, সেখানে ক্ষমতাসীন দলে নেতা উপচে পড়াটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দল তাদের কোনো নেতাকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করতেই পারে। কিন্তু সরকারি সংস্থায় তাদের পুনর্বাসিত করা কতটা নৈতিক?
প্রতি মাসে তাঁদের বেতন, সম্মানী ভাতা দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যায়। ভ্যাট, আয়কর কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের মাধ্যমে সেই টাকাটার জোগান নাগরিককেই দিতে হয়।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী