‘যদি রাশিয়া ব্যর্থ হয়, একুশ শতকের জন্য সব সম্ভাবনা বাজিতে হেরে যাবে এবং যদি রাশিয়া একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে সফল হয়, তবে সেই সাফল্যের জন্য রাশিয়া অনেকটাই ঋণী হয়ে থাকবে একজন ব্যক্তির কাছে; তিনি হলেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন।’ ২০০৭ সালে পুতিনকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে এ মন্তব্য করেছিল টাইম ম্যাগাজিন।
আদতে বাস্তবতা হলো, পুতিনকে আপনি প্রশংসা করুন আর তুচ্ছ করুন, ২০২২ সালে এসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বিশ্বের বুকে নিজের অমোচনীয় ছাপ রেখেছেন, তা মানতেই হবে।
ইউক্রেন আক্রমণ করে এবং পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ করে ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছেন। তিনি আমেরিকার একক আধিপত্য-উত্তর বহুপক্ষীয় শক্তির বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। এটি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদেরা ২০২২ সালের আগের এবং তার পরের বিশ্বের কথা বলবেন।
জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিগত বাবুর্চি ইস্পিরিদোন ইভানোভিচ পুতিনের নাতি ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। আর এই বছর তিনি ইউরেশীয় মহাদেশের কেন্দ্রস্থলে ন্যাটো সম্প্রসারণের ওপর মারাত্মক আঘাত করেছেন। এ ছাড়া পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই হোক আর কাকতালীয়ভাবে হোক, তিনি বৈশ্বিক ডলার ব্যবস্থার মাঝখানে একটি বোমাও পুঁতে দিয়েছেন।
পশ্চিমা সরকারগুলো রাশিয়ার সঙ্গে তাদের এ মহাকাব্যিক প্রক্সি-যুদ্ধকে গণতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের মধ্যকার সংঘাত হিসেবে দেখাচ্ছে। একটি সীমিত কিংবা বলা যায় সংকীর্ণ পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে একটি গ্রহণযোগ্য ও বিপণনযোগ্য বয়ান মনে হতে পারে; কিন্তু অ–পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগই এ বয়ান বা ভাষ্য আর কিনতে চাইছে না। পূর্ব এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ দেশ ইউক্রেনের সংঘাতকে বিশ্ববাদ বনাম সার্বভৌমত্বের যুদ্ধ হিসেবে দেখছে।
বলা হয়, পশ্চিমা নিয়মের অধীনে পরিচালিত বিশ্বায়নের ফলে জাতীয় সরকারগুলোর নিজ নিজ অর্থনীতিকে নির্দেশিত ও প্রভাবিত করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এটি দেশগুলোর নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণের ক্ষমতা হ্রাস করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে বিলম্বে হলেও বুঝতে সহায়তা করেছে যে ইউরোপীয় কমিশন ইইউর পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিষয়ে পশ্চিমাদের ঘোষিত আদর্শের পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অ-পশ্চিমা বিশ্বের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
যদি রাশিয়া তার জ্বালানি রপ্তানির পুরোটা বা কিছু অংশ বন্ধ করে দেয়, তখন ইইউ তার জ্বালানি কোথায় পাবে? যদি চীন, ভারত এবং সৌদি আরব পরিকল্পনায় স্বাক্ষর না করে?—এসব প্রশ্নের জবাব আগে থেকে ভাবা হয়নি। এ কারণে আজকের যুদ্ধ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এ জটিল পরিস্থিতির জন্য এককভাবে রাশিয়াকে দায়ী করা যাবে না।
রাশিয়ান ট্যাংক ইউক্রেনে প্রবেশ করার পর পশ্চিম রাশিয়ার শত শত কোটি ডলার রিজার্ভ জব্দ করে ফেলে এবং ডলারের বিশ্বব্যাপী আদান-প্রদান ব্যবস্থা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) থেকে একতরফাভাবে দেশটিকে বহিষ্কার করে। এ সিদ্ধান্তকে অন্যায় বলার মতো কোনো আদালত দেখা যায়নি। পশ্চিমারা রাশিয়ান পাসপোর্ট বহনকারী অনেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ইয়ট বা প্রমোদতরি বাজেয়াপ্ত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইইউ আটলান্টিসিস্ট মিত্রদের একমাত্র সোজাসাপ্টা পরিকল্পনা ছিল: রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে না যাওয়া বা ক্রেমলিনে পুতিনের জায়গায় আরেকজন নেতা না বসা পর্যন্ত ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লড়াই করতে দাও। এ যুদ্ধে স্পষ্টতই পশ্চিমারা বিকল্প পরিকল্পনা বা ‘প্ল্যান বি’ রাখেনি। অর্থাৎ ‘যদি এটা না হয় তাহলে কী হবে?’—এ ভাবনা তারা রাখেনি।
যদি রাশিয়া তার জ্বালানি রপ্তানির পুরোটা বা কিছু অংশ বন্ধ করে দেয়, তখন ইইউ তার জ্বালানি কোথায় পাবে? যদি চীন, ভারত এবং সৌদি আরব পরিকল্পনায় স্বাক্ষর না করে?—এসব প্রশ্নের জবাব আগে থেকে ভাবা হয়নি। এ কারণে আজকের যুদ্ধ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এ জটিল পরিস্থিতির জন্য এককভাবে রাশিয়াকে দায়ী করা যাবে না।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জান ক্রিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাবেক জাপানি সংবাদদাতা ও হংকং থেকে প্রকাশিত এশিয়া ২০০০ ম্যাগাজিনের সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।