কদু, কুমড়ো, কচু, কপি, কাঁকরোল তেতে উঠেছে। এর মাঝে জ্বালা ধরানো ঝাঁজে বাজে কোয়ালিটির পেঁয়াজেও চোখ ফেলা যাচ্ছে না। বেগুনে আগুন লেগেছে। গাজরের গাঁজাখুরি দর গায়ে জ্বর ওঠাচ্ছে। পুঁইশাক পর্যন্ত টাকাওয়ালার ট্যাঁকে পাক খাওয়াচ্ছে। মেপে এক কেজি পেঁপে কিনতেও গা কেঁপে উঠছে। খেপে যাওয়া খদ্দেরের সঙ্গে বিক্রেতার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায় গড়াচ্ছে। সেই তালে বেড়ে চলা মরিচের ঝালে কাস্টমারের খালে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছা করছে। ‘আম-জাম’ সবকিছুর দাম বাড়ছে। শিম থেকে ডিমের দামের দশায় রাজারও বাজার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মনে হচ্ছে, বাজারে যেসব মনিটরিং টিম আছে বলে বলা হচ্ছে, ওগুলো আসলে টিম না, ওগুলো আসলে হাট্টিমাটিম টিম। এই টিম মাঠে ডিম পাড়ে না। পাড়লে খালি খালি ডিমের হালি ৫০ টাকা হতো না। আণ্ডার দাম ঠান্ডা মাথা গরম করে ফেলছে।
ঢাকায় পরশুদিন এক পাল্লা পেঁয়াজ কিনেছি ৬৩০ টাকায়। সেই পেঁয়াজের দাম গতকাল ছিল ৭৪০ টাকা। লেবুর হালি ৩০ টাকা; কুমড়োর ফালি ৫০ টাকা। তুলোর মতো সাদা মুলোর কেজি ৬০ টাকা। বাঁধাকপির বাঁধা দাম নিয়েছে ৫০ টাকা। কিনতে গিয়ে তুলতে হয় কি না, সেই আতঙ্কে পটোলের দাম জিজ্ঞেসই করিনি।
এর মধ্যে আলুর দামে কালু-ফালু সবার ব্রহ্মতালু গরম হয়ে যাচ্ছে। কেজিপ্রতি ৬৫ টাকায় আলু কিনে আজকালকার দিনে চলতে গেলে ধারকর্জ-ঋণে জড়ানো ছাড়া উপায় আছে? এর মধ্যে খবর এসেছে ১২ হাজার টন আলুর আমদানি নাকি চালু হয়েছে। দু–এক দিনে সব ভয় কাটিয়ে দেশ নাকি আলুময় হবে। তাতে নাকি দাম কমবে। তখন নাকি ‘আলু আমার আলু ওগো, আলু দেশ ভরা...’ গাইতে গাইতে গিন্নি-কর্তা ভাজি-ভর্তা খেয়ে ভাতের ওপর চাপ কমাতে পারবে। তখন সর্বগুণে গুণান্বিত আলুর আর কোনো দোষ থাকবে না।
কিন্তু এখন কী দশা, সেটাই বড় কথা। মধ্যবিত্তের শ্বাস উঠছে; দিনমজুরের নাশ না হলেও ভিক্ষুক হতে বাকি আছে। ঢাকায় যে শ্রমিকের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা, তার ফ্যামিলির চাকা কেমন করে ঘোরে এই বাজারে? বউ–ছেলেমেয়ে নিয়ে সে কয় বেলা খায় আর কয় বেলা না খেয়ে কাটায়? এই নিয়ে গবেষণা খুব একটা চোখে পড়ে না।
দেখা যাচ্ছে, চাল-ডালের দাম বাড়ার পেছনে যত না হাত আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অজুহাত। অজুহাতের হাত অনেক লম্বা। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় পাবলিকের অসহনীয় হওয়া ঘায়ের ওপর সহনীয়তার মলম হিসেবে প্রথমে ডলা হয়েছিল যে আজদাহা অজুহাত, তার নাম ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’। তাই নিয়ে তাইরে-নাইরে করে বছর দেড়েক পার।
এরপর তেলের দাম, নুনের দাম বাড়লে আসে সিন্ডিকেটের কথা। সরকার একবার বলে, মোটা থেকে মিনিকেট—কোনো চালের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য সিন্ডিকেট ভাঙব। আরেকবার মজুতদারদের ক্ষমতার দিকে ইন্ডিকেট করে বলে, সিন্ডিকেট খুব শক্ত, অনেক মহল এর ভক্ত, এই জিনিস ভাঙা যাবে না।
এখন নতুন অজুহাত এসেছে। সেটা হলো, রাজনীতির গরম পরিস্থিতি। এ কারণেই নাকি বাজারের স্থিতি থাকছে না। হরতাল-অবরোধ-মিটিং-সমাবেশ দেখে রাজনীতিকদের এক পক্ষ ‘বেশ! বেশ!’ করছে। অন্য পক্ষ প্রতিপক্ষের চক্রান্তের তলদেশ হাতড়াচ্ছে। মাঝখান থেকে দ্রব্যমূল্যের জ্বালা পাবলিকের জান ফালা ফালা করে ফেলছে।
কিছুদিন আগেও একটা একটা করে আইটেম ধরে দাম বাড়ত। কিছুদিন পেঁয়াজ, কিছুদিন মরিচ, কিছুদিন নুন, কিছুদিন চুন নিয়ে ধারাবাহিক খেলাধুলা চলত। এর আগে তেলের খেল দেখেছি। পেঁয়াজের আজেবাজে ঝাঁজে কপালের মাঝে ভাঁজ দেখেছি। কাঁচা মরিচের নাচানাচি দেখেছি। লাল মরিচের ঝাল দেখেছি। নুনের বাজারে চুনের মতো গাল পোড়ানো দাম দেখেছি। বেগুনের ওপর দিয়ে ‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভোমরা’ উড়তে দেখেছি। ডিমের দাম নিয়ে কারওয়ান বাজারের চিকেন মার্কেটে দোকানদার-কাস্টমারের মারামারি দেখেছি। তারপর আদার গডফাদারদের দাদাগিরি দেখেছি।
কিন্তু এবার সবকিছু একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ করেছে। চাল-ডাল-তেল-নুন থেকে শুরু করে আলু পর্যন্ত ধরা যাচ্ছে না। ছোঁয়া যাচ্ছে না। গরিবের কাছে সব অধরা হচ্ছে। অথচ তাদেরও উদর আছে। বাজারের লিস্টি থেকে মধ্যবিত্ত টুক করে টক-মিষ্টি বাদ দিচ্ছে; মাংস বাদ পড়ে যাচ্ছে; মাছও পাত থেকে ছুটে চলে যাচ্ছে। আর মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়ে অনেক আগেই শাকাহারী হওয়া গরিব মানুষ সবজির দরদাম দেখে পারমান্যান্ট অনাহারী হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
মেনে নিচ্ছি, শীতের শুরুতে সবজির দাম একটু বেশি থাকতে পারে। তাই বলে এত বেশি? বিদেশি পেঁয়াজ-রসুন-আদা হলে এক দর, দেশি হলে হয়তো কিছু বেশি। তাই বলে এত? এতটা ফারাক?
আদতে কেউ কিছু দেখছে না। কেউ কিছু বলছে না। ‘যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা’। সরকার ঘোষণার খুঁটিতে দাম বেঁধে দিচ্ছে। সেই দাম সরকারি বাঁধন ছিঁড়ে বাছুরহারা গরুর মতো যেদিকে মন চায় ছুটছে। তার গলায় দড়ি পরানোর রেগুলেটরি বডি কি নোবডি হয়ে গেল?
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক