মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। গত মে মাসে যখন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতির ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ব্যাপারটা ছিল, দেখা যাক কী হয়। এখন আর দেখাদেখির বিষয় নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা বা এ ধরনের বিষয়ে জড়িত থাকা অন্যদেরও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হতে পারে।
এর আগে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচনে কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন এবং নাগরিক ও গণমাধ্যমের বাক্স্বাধীনতায় যারা বাধা দেবে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা কথার ফানুস ওড়াতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য হলো, আমরা তো বলেই দিয়েছি, সরকার একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে চায়। অতএব, এই ভিসা নীতি আমাদের ওপর প্রযোজ্য হবে না। বরং নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা রাজপথে গোলযোগ সৃষ্টি করছে, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই এই ভিসা নীতি কার্যকর হবে।
অন্যদিকে বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হলো, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালে একতরফা ও ২০১৮ সালে জবরদস্তির নির্বাচন করেছে। ভবিষ্যতেও তারা আরেকটি কারচুপি ও একতরফা নির্বাচন করতে চাইছে। ফলে ভিসা নীতি তাদের ওপরই প্রয়োগ হবে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সচিব ডোনাল্ড লু ডেইলি স্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই নীতি ঘোষণা করার পর থেকে সার্বিক ঘটনা আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি। সাক্ষ্য-প্রমাণ ভালোভাবে পর্যালোচনা করার পর আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন বা ব্যাহত করা বলতে আপনারা কী বুঝিয়েছেন। তিনি এর জবাবে বলেছেন, ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সংগঠনের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা থেকে বিরত রাখতে সহিংসতা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা মতামত প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমের ওপর পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের মতো কারণে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্নকারীদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপক তথ্য এবং প্রতিটি তথ্য প্রমাণ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই নীতির আওতায় কাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করে। আমরা এই প্রক্রিয়া সরকার, বিরোধী দল ও নিরাপত্তা সংস্থার ওপর সমান ও যথাযথভাবে প্রয়োগ করি।
আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রাজনীতিকদের এক টেবিলে বসাতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তও তাদের টনক নাড়াতে পারেনি। মার্কিন ভিসা নীতির বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়া শুরু হয়েছে। দুই দলের দুই দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, এই বিধিনিষেধ দেশের জন্য লজ্জাজনক। এই লজ্জা কি তাদের এক টেবিলে বসাতে পারবে? যদি পারে, দেশবাসী একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন পেতে পারে। যদি না বসাতে পারে কী হবে, কেউ জানে না।
মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের দশ নেতা অন্তত বিশ ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ বলেছেন, এটা তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে। কেউ বলেছেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আবার কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের কারণেই মার্কিন ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু ডোনাল্ড লুর কথায় সেটা প্রমাণিত হয় না। র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সময়ও আওয়ামী লীগ নেতার শোরগোল তুলেছিলেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য অনেক লবিস্টও নিয়োগ করেছিলেন। কাজ হয়নি।
মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে অন্যরা গয়রহ মন্তব্য দিলেও অন্তত দুই দলের দুই দায়িত্বশীল নেতা এর গভীরতা উপলব্ধি করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ দেশের জন্য লজ্জাজনক।’ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন,‘ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধের ঘটনাটি দেশের জন্য লজ্জা ও অপমানজনক।’
এখন প্রশ্ন হলো দুই দলের নেতৃত্ব কি সেই লজ্জা ও অপমান মুখ বুঝে হজম করবেন, না প্রতিকারের চেষ্টা চালাবেন? প্রতিকার হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা। প্রতিকার হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধাগুলো দূর করা। সেই কাজটি করা কঠিন নয়, অসম্ভবও নয়, যদি দুই দলের নেতৃত্ব করতে চায়।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে যে ফারাক ছিল, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সেটা অনেকটা ঘুচে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ ও এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ মেনে নিয়েছে। আবার চার মূলনীতিও পুনঃস্থাপন করেছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়ে এখন খুব উচ্চবাচ্য করে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনায়ও তেমন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। দুই দলই ধনী আরও ধনী হোক ও গরিব আরও গরিব হোক—এই নীতিতে বিশ্বাসী। আগে বিএনপি-জাতীয় পার্টিকে ব্যবসায়ীদের দল বলা হতো। এখন আওয়ামী লীগও ব্যবসায়ীদের দলে পরিণত হয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ নিয়ে বহুবার আক্ষেপ করেছেন।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হলো ক্ষমতায় নেওয়ার ও রাখার মালিক যে জনগণ তাদের ওপর আস্থা না রাখা। যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী রায় নিজের পক্ষে আনা। এই কাজটি করতে নির্বাচনের যে সর্বজনীন রীতি আছে, সেটাও তারা মানেন না। অনেক আগে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক করতে পারেনি নির্বাচনটি কীভাবে হবে?নির্বাচনের বিষয়ে যদি তাঁরা ঐকমত্য হতে না পারেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে?
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কিংবা অন্য বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। সেটাই রীতি। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা মুখোমুখি হতে চান না। তাঁরা সবকিছু রাজপথে ফয়সালা করতে আগ্রহী। দেশের রাজনীতি নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিকেরা কথা বললে রাজনীতিবিদেরা সুনজরে দেখেন না। তাঁরা ভাবেন, এ নিয়ে আর কারও কিছু বলার দরকার নেই। রাজনীতিকেরা যা ভাবেন, সেটাই শ্রেষ্ঠ ভাবনা। যা করেন, সেটাই শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র।
দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, আপনারা আলোচনায় বসুন। মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে রেহাই দিন। আগে দাবি-দাওয়া আদায় করতে বিরোধী দল রাজপথে থাকত। এখন সরকারি দলও মাঠে নেমেছে। কিন্তু দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে ঢাকা শহরে সপ্তাহে তিন-চার দিন জনজীবন অচল হতে বসেছে, এ বিষয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রাজনীতিকদের এক টেবিলে বসাতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তও তাদের টনক নাড়াতে পারেনি। মার্কিন ভিসা নীতির বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়া শুরু হয়েছে।
দুই দলের দুই দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, এই বিধিনিষেধ দেশের জন্য লজ্জাজনক। এই লজ্জা কি তাদের এক টেবিলে বসাতে পারবে? যদি পারে, দেশবাসী একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন পেতে পারে। যদি না বসাতে পারে কী হবে, কেউ জানে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি