পাকিস্তান তার ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। মাঝে মাঝে স্বল্প বিরতিতে সেখানে গণতন্ত্র এসেছে।
সামরিক বাহিনী যখনই প্রচণ্ড অজনপ্রিয় হয়ে চাপের মুখে পড়েছে এবং চাপের মুখে পড়ে যখন তারা গণতন্ত্রকে সুযোগ দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনই দেশটিতে অস্থায়ীভাবে গণতন্ত্র মাথা তুলতে পেরেছে।
সর্বশেষ সামরিক শাসক ২০০৮ সালে বিদায় নিতে বাধ্য হন। এর পর থেকে পাকিস্তান তার ইতিহাসের দীর্ঘতম বেসামরিক শাসনের সময়কাল দেখছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে গেছে এবং গত বছর দেশটি একটি ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থা থেকে ‘স্বৈরাচারী’ শাসনব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে।
দেশটির নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্র এখন সাধারণ পাকিস্তানিদের কাছে তো বটেই, বিশ্ববাসীর কাছেও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
তবে আমরা আজকের এই অবস্থায় হঠাৎ এসে পড়িনি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য সান অলসো রাইজেস বইয়ে একটি চরিত্র আরেকটি চরিত্রকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কীভাবে দেউলিয়া হলে?’ উত্তরে অপর চরিত্রটি বলে, ‘দুই ভাবে। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর ধপাস করে।’
গত এক দশকে পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এই ধ্বংস ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করেছে। ক্ষমতার লোভে তারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করেছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করতে সামরিক প্রভাব ব্যবহার করেছে। এভাবে তারা আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মানদণ্ড এবং দেশের সংবিধানকে শেষ করে দিয়েছে।
সর্বশেষ দুটি নির্বাচন ছিল অনিয়মে ভরা। এই নির্বাচন রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে তা আরও জটিল করেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খান ক্ষমতায় আসেন। সে নির্বাচনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম হয় এবং ২০২৪ সালে তাঁকে ক্ষমতা থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৮ সালে যে ইমরান সামরিক বাহিনীর মিত্র ছিলেন; ২০২৪ সালে সেই ইমরান তাদের শত্রুতে পরিণত হন।
এখন ইমরান সেই অবস্থানে রয়েছেন, যেখানে বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর প্রতিপক্ষরা ছিলেন। অর্থাৎ তিনি আছেন কারাগারে; তিনি আছেন সময় বদলানোর অপেক্ষায়।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন গণতন্ত্র এবং ধ্বংসের মাঝামাঝি একটি সংকটময় মুহূর্তে ঝুলে আছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় দেশটিকে জনগণের মত অনুযায়ী তথা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে চলতে হবে; নয়তো ‘ধীরে ধীরে এবং ধপাস করে’ ধ্বংসের খাদে পড়ে যেতে হবে।
ইতিহাস যদি ঘুরেফিরে আসে, তাহলে ইমরান খানের জন্যও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে; ঠিক যেমন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, সামরিক বাহিনীকে কেন পাকিস্তান শাসনের অধিকার দেওয়া হয়? এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং রাজনীতিকেরা এখনো সামরিক বাহিনীর প্রতি ‘আমাকে দেখ, আমাকে নাও’ নীতি নিয়ে হাঁটছেন।
ফলে দেশে নানা উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। রাষ্ট্র ভিন্নমতকে দমন করতে চেষ্টা করছে। ইমরান খানের দলকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের জাতিগত পশতুনদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে আসা সংগঠন পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্টকে সম্প্রতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আটক হওয়া দুজন নাগরিক গত মাসে পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছেন। কীভাবে এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ধর্মীয় চরমপন্থার বাড়বাড়ন্ত এসব হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছে কি না, তা নিয়েও কোনো কথা উঠছে না।
রাজনীতির ফোকাস যখন জনকল্যাণ থেকে সরে এসে অভিজাত গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতার রশি টানাটানির দিকে নিবদ্ধ হয়, তখন সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে সাধারণ মানুষ।
এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার চক্র পাকিস্তানের অর্থনীতিকে লাগাতারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিনিয়োগ উবে যাচ্ছে এবং এক কোটি ২৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। স্কুল থেকে ছিটকে পড়া শিশুদের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৫৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। এসব শিশুর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির বয়স ৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ এখনো হতাশাজনকভাবে কম।
গত মাসে পাকিস্তান তার ইতিহাসের ২৫তম আইএমএফ বেইলআউট কর্মসূচিতে প্রবেশ করেছে। এই বেইলআউট পাকিস্তানকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচালেও আইএমএফের কথামতো লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণ এবং কর বৃদ্ধির মতো কিছু সংস্কার চালু করতে হয়েছে। এগুলো এতটাই অজনপ্রিয় যে আগের সরকারগুলো জনরোষের ভয়ে এসব পদক্ষেপ নিতে চায়নি।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনের বদলে তা আরও জটিল করে তুলেছে।
সুপ্রিম কোর্ট ও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়া যাতে আরও বেশি হাতের মুঠোয় নেওয়া যায়, সে জন্য গত সপ্তাহে সরকার কোনো ধরনের আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই একটি বিতর্কিত সংশোধনী অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার কমিশন (আইসিজে) এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান এই সংশোধনীকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে সমালোচনা করেছেন।
দেশের ভেতরের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকার বেকায়দায় আছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া এবং তালেবানের কাবুল দখলের পর থেকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণ হারিয়েছেন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তানে নিরাপত্তাব্যবস্থা বছরের পর বছর তালেবানকে মিত্র মনে করে ভুল পথে চলেছে। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় তালেবানের ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেবে এবং তারা পাকিস্তানের বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তালেবান তাদের ইসলামি আমিরাতকে সম্প্রসারণ করতে চায় এবং টিটিপির ঘোষিত লক্ষ্য হলো পাকিস্তানি সংবিধান ও সরকারকে উচ্ছেদ করে পাকিস্তানে শরিয়াহ শাসন চালু করা।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন গণতন্ত্র এবং ধ্বংসের মাঝামাঝি একটি সংকটময় মুহূর্তে ঝুলে আছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় দেশটিকে জনগণের মত অনুযায়ী তথা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে চলতে হবে; নয়তো ‘ধীরে ধীরে এবং ধপাস করে’ ধ্বংসের খাদে পড়ে যেতে হবে।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মুস্তাফা নওয়াজ খোখার একজন সাবেক পাকিস্তানি সিনেটর, যিনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।