আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা, আমি চাই না আমার সন্তান অতিরিক্ত সুবিধা পাক

আমরা আবার ধর্মঘট-অবরোধের যুগে প্রবেশ করলাম। এখন টক অব দ্য কান্ট্রি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন স্কিম নিয়ে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট এবং সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন। কঠোর অবরোধ কর্মসূচিও পালন করেছে তারা।

কোটার এই আন্দোলন অবশ্য দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে যখন আন্দোলন হয়েছিল, ছাত্ররা তখন চেয়েছিল কোটার সংস্কার। কিন্তু সরকার কারও পরামর্শ না শুনে একতরফাভাবে কোটা বাতিল করে দেয়। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল।

আদালতের একটি রায় ঘিরে সম্প্রতি আবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। ২০১৮ সালেই সরকার কেন কোটার বিষয়টি আদালতে নিয়ে যায়নি, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু কোটাব্যবস্থা বাতিলের এত দিন পর হঠাৎ পরিস্থিতি গরম করার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, জানি না।

আমাদের এখানে এ ধরনের আন্দোলনে নানা মহল সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। কেউ আন্দোলনের সুবিধা নেয়, কেউ ভুক্তভোগী হয়। একসময় দেখা যায়, আন্দোলন ছত্রখান হয়ে যায়। আমরা শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ-সমাবেশ দেখেছি দিনের পর দিন। নগরবাসী একেবারে নাকাল দশায় পড়ে গিয়েছিল।

মানুষ সে পরিস্থিতি মুখ বুজে সহ্য করেছিল, কিংবা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটা সংশ্লিষ্ট ছিল। যাহোক, কিছুদিন পর দেখা গেল, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনটাকে স্তিমিত করে দেওয়া হলো। ২০১৮ সালে স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও একসময় স্তিমিত করে দেওয়া হলো।

সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেখানে খুব সংবেদনশীল প্রশ্ন হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কোটার সম্পর্ক কী? মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছেন, সেই প্রজন্মের কারও তো এখন আর চাকরির বয়স নেই।

দ্বিতীয়ত, অনেকে মনে করেন এত বীর মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে ছিলেনও না। এখন একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড লোভ জাগ্রত করা হয়েছে। তারা আজীবন এই সুবিধাগুলো পেতে চায়।

আমি নিজে তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি কখনো কল্পনা করতে পারি না, আমার সন্তানেরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে অতিরিক্ত সুবিধা পেতে চাইবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকের মধ্যে সেটাই দেখা যাচ্ছে।

আমাদের এখানে তরুণদের নিয়ে রাজনীতিবিদেরা খেলতে খেলতে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে সেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কষ্টকর। কোটা নিয়ে আন্দোলন কেন হচ্ছে? ছেলেমেয়েরা কেন পাগল বিসিএসের জন্য। কারণ, তাঁরা জানেন, এটা সবচেয়ে নিরাপদ চাকরি। তাঁদের অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি—সবই হবে। তাঁদের এ ভাবনা অমূলক নয়। কারণ, চারপাশে যেসব উদাহরণ দেখছি, তাতেই এটা পরিষ্কার।

যাহোক, শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীসহ গোটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে। ঢাকা তো রীতিমতো অচলই হয়ে পড়ে। আমাদের এখানে কথায় কথায় সড়ক অবরোধ হয়। দাবি যতই যৌক্তিক হোক না কেন, সড়ক অবরোধে সরকারের তেমন ক্ষতি হয় না। কোনো ভিআইপি যখন কোথাও যান, তখন তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাস্তা খালি করে দেয়, মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়। ভিআইপিরা তো মানুষের দুর্ভোগটা বুঝতে পারেন না।

আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়া আমাদের এখানে দীর্ঘদিনের একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দল, জামায়াতে ইসলামী—সবাই মিলে দিনের পর দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিল। কিন্তু এত অবরোধ, আন্দোলন করার পরও এরশাদ সাড়ে ৯ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। পরে সামরিক বাহিনী এরশাদের কাছ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাঁর পতন হয়।

আমি মনে করি, এরশাদের পতনটা ছিল একধরনের অভ্যুত্থান; যদিও আন্দোলনকারীরা ধরে নেন, তাঁদের আন্দোলনের কারণে এরশাদের পতন হয়েছে। যে যেভাবেই দেখুক না কেন, সাধারণ মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আন্দোলনকারীরা তখন বলেছিলেন, তাঁরা গণতন্ত্রের জন্য এটা করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের কী অবস্থা, সেটা তো আমরা ১৯৯১ সাল থেকে পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে দেখতেই পাচ্ছি। 

যাহোক, তখন থেকেই অবরোধের সংস্কৃতিটা ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে। পরে খালেদা জিয়ার সরকার যখন ছিল, আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো লাগাতার ধর্মঘট, অবরোধ, হরতাল করেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেন, এর কিছুদিনের মধ্যে খালেদা জিয়া শুরু করলেন লাগাতার সংসদ বর্জন। তারপর শুরু হলো লাগাতার হরতাল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার আমলে অবরোধ, হরতাল চলতেই থাকল। ২০০৬ সালজুড়ে অবরোধ, হরতাল, সহিংসতার পর এক–এগারো এল। আমার প্রশ্ন হলো, অবরোধ, হরতাল করে তো কোনো লাভ হয় না। তাহলে অধিকার, গণতন্ত্র, নাগরিক সুবিধা—এগুলো তো ছেঁদো কথা।

দুই.

আমাদের এখানে তরুণদের নিয়ে রাজনীতিবিদেরা খেলতে খেলতে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে সেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কষ্টকর। কোটা নিয়ে আন্দোলন কেন হচ্ছে? ছেলেমেয়েরা কেন পাগল বিসিএসের জন্য। কারণ, তাঁরা জানেন, এটা সবচেয়ে নিরাপদ চাকরি। তাঁদের অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি—সবই হবে। তাঁদের এ ভাবনা অমূলক নয়। কারণ, চারপাশে যেসব উদাহরণ দেখছি, তাতেই এটা পরিষ্কার।

সচিব হয়ে অবসরে গেলে তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে, তিনি মন্ত্রী হবেন, এমপিও হবেন। সচিব থাকাকালে তিনি তাঁর সংসদীয় এলাকায় তথাকথিত উন্নয়নের নামে জনগণের টাকা খরচ করবেন। অবসর নেওয়ার পর ভোট চাইবেন। ফলে তরুণদের ঝোঁক বিসিএসের দিকেই যাবে। অন্য কোনো চাকরি বা স্বনিয়োজিত পেশায় তরুণেরা তেমন উৎসাহ বোধ করেন না। তাঁরা মনে করেন, বিসিএসের চাকরিতেই প্রাপ্তিযোগ বেশি। 

আরেকটি বিষয় এখানে প্রচ্ছন্নভাবে আছে। তা হলো কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তরুণদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাঁরা মনে করেন, যেভাবেই হোক একটা কাজ জোটাতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটা বৈষম্যমূলক নিয়োগপ্রক্রিয়াকে তাঁরা বাধা বলে মনে করছেন।

আর যাঁদের সামর্থ্য ও সুযোগ আছে, তাঁদের অনেকেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, এ দেশে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। দেশে ভবিষ্যৎ যে নেই, সেটা তো আমাদের নেতা–নেত্রীরা অনেক আগে থেকেই দেখাচ্ছেন। কারণ, সন্তানদের তাঁরা অনেক আগেই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেশে যদি কোনো রাজনীতিবিদ মারা যান, তাঁর সন্তান বিদেশ থেকে এসে টুপ করে মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়ে যান।

শিক্ষকেরা তাঁদের পেশাগত অবস্থান থেকে ধর্মঘট করছেন। যদিও জনগণের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সমস্যা নিয়ে তাঁরা কোনো কথা বলেন না। বেশির ভাগের চেষ্টা থাকে সরকারের সঙ্গে সংযোগ রেখে কীভাবে সুবিধা আদায় করা যায়। তাঁদের দাবিও সরকারের কাছে। কিন্তু তাঁদের আন্দোলনে সরকারের তো কিছু যায়–আসছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্ররা। 

জনগণের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলের অবস্থান একই রকম। তারা যখন ক্ষমতায় থাকে এক আচরণ করে, বিরোধী দলে গেলে উল্টো আচরণ করে। সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে তারা আন্দোলন করে। ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলনেও ভিন্ন চিত্র দেখছি না। ছাত্রদের অবরোধ আর শিক্ষকদের ধর্মঘটে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে সময়টা আমাদের এখন ভালো যাচ্ছে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক