প্রত্যয় স্কিমের ‘ডাবল বেনিফিট’ এবং ‘শুভংকরের ফাঁকি’

সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আসা সদস্য গোলাম মোস্তফা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বর্তমানে প্রাপ্ত পেনশন-সুবিধা এবং প্রত্যয় স্কিমের পেনশন সুবিধা নিয়ে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, বর্তমান যে পেনশন-সুবিধা, তাতে যদি কোনো অধ্যাপক ১৫ বছর ধরে পেনশন পান, তাহলে তিনি পাবেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৪ হাজার ৩০০ টাকা।

আর যদি প্রত্যয় স্কিমের পেনশন ‍সুবিধা পান, তাহলে ১৫ বছরে মোট পাবেন ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, ‘প্রত্যয়’ স্কিমে ‍সুবিধা বেশি।

তবে এই হিসাবের মধ্যে বড় ধরনের একটা ফাঁকি আছে। এই ফাঁকিটার নাম ‘টাইম ভ্যালু অব মানি’ বা টাকার সময়মূল্য। তিনি একটি অসম তুলনা করে কোনোরকমে ‘প্রমাণ করে’ দিয়েছেন, প্রত্যয় স্কিমে সুবিধা বেশি।

সুবিধা বেশি না কম, সেটি একটি হিসাবের মাধ্যমে এখন বোঝার চেষ্টা করি।

আরও পড়ুন

প্রথমে বোঝার চেষ্টা করি ‘টাকার সময়মূল্য’ কী। মনে করুন, আপনার কাছে ১০০ টাকা আছে।

এই ১০০ টাকা দিয়ে আপনি আজকে যে পরিমাণ পণ্য কিনতে পারবেন, ১ বছর, ২ বছর, ৫ বছর বা ১০ বছর পরে সেই সমপরিমাণ পণ্য কিনতে পারবেন কি না।

অর্থাৎ এ সময়মূল্য দিয়ে দেখা হয়, টাকার ক্রয়ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নাকি কমছে। যদি এই ১০০ টাকা দিয়ে এক বছর পরও আজকের মতো সমপরিমাণ পণ্য কিনতে পারেন, তাহলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা সমান।

যদি আজকের চেয়েও বেশি পণ্য কিনতে পারেন, তাহলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। যদি আজকের চেয়েও কম পণ্য কিনতে পারেন তাহলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।

সাধারণত মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে। আপনি আপনার আশপাশের বিভিন্ন পণ্যের আজকের দাম এবং ৫ বছরে আগের দামকে তুলনা করলেই সহজে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।

আরও পড়ুন

এবার আসি ফাঁকির জায়গায়। মোস্তফা সাহেব প্রত্যয়ের যে হিসাবটা দিয়েছেন, সেটি হচ্ছে আজ থেকে ৪৫ বছর পরের।

ধরে নেওয়া হয়েছে, একজন আজ থেকে ৩০ বছর পরে অবসরে যাবেন এবং প্রতি মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা করে ১৫ বছরে সর্বমোট এই টাকা পাবেন।

অন্যদিকে বর্তমান পেনশন ব্যবস্থার হিসাবটা আজ থেকে ১৫ বছর পরের।

অর্থাৎ কেউ যদি আজকে পেনশনে যান এবং পরবর্তী ১৫ বছর পেনশন পান তাহলে মোট ওই টাকাটা পাবেন।

মাঝখানে ৩০ বছরের একটা সময় পার্থক্য আছে। দেখতে হবে এই ৩০ বছরে অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কত কমবে।

পেনশন কর্তৃপক্ষের হিসাবে যদি একজন ২০২৪ সালের ১ জুলাই শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন এবং মাসে ৫ হাজার টাকা করে পেনশন কর্তৃপক্ষকে দেন, তাহলে ২০৫৪ সালের ১ জুলাই থেকে তিনি ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা করে মাসিক পাবেন।

আরও পড়ুন

টাকার সময়মূল্য হিসাব করার দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো বর্তমান টাকার ভবিষ্যৎ মূল্য এবং অন্যটি ভবিষ্যৎ টাকার বর্তমান মূল্য।

ভবিষ্যৎ টাকার বর্তমান মূল্য হিসাব করা হয় এভাবে, বর্তমান মূল্য = ভবিষ্যৎ মূল্য/ (১ + সুদের হার) ^ সময়।

এই সূত্র দিয়ে যদি সেই শিক্ষকের প্রথম মাসের পেনশনের টাকার বর্তমান বাজারমূল্য বের করি তা হবে ৫ হাজার ৪৪৫ টাকা (সুদের হার ১১ শতাংশ ধরে)। এই টাকার অর্ধেক আবার সেই অধ্যাপকের নিজের টাকা যেটা তিনি মাসিক চাঁদা হিসেবে দিয়েছিলেন।

আর আজকে যদি কোনো অধ্যাপক অবসরে যান তাহলে তিনি এককালীন ৮০ লাখ ৭৩  হাজার টাকা পাবেন এবং মাসিক ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা করে পাবেন।

এই এককালীন টাকা যদি ‘রিস্ক ফ্রি ইনভেস্টমেন্ট’ বা ঝুঁকিবিহীন বিনিয়োগ হিসেবে সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন তাহলে সর্বনিম্ন ১১ শতাংশ হারে মাসিক ৭৪ হাজার ২ টাকা করে মুনাফা পাবেন।

বর্তমান পদ্ধতিতে বছরে দুটি উৎসব বোনাস এবং একটি বৈশাখী ভাতা পাওয়া যায়। সে টাকা হিসাব করলে মাসিক আরও ৬ হাজার ৪৩৫ টাকা করে পাওয়া যাবে।

সব মিলিয়ে আজকের দিনে একজন অধ্যাপক অবসর-সুবিধা পাবেন মাসে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৭ টাকা। এবং বছর বছর এই টাকা বাড়বে।

যদি সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের হার সমানও ধরা হয় তবু ১৫ বছর পর একজন অধ্যাপকের মাসিক পেনশন-সুবিধা পাবেন ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৭।

এই টাকায় অধ্যাপকের নিজের কোনো চাঁদা নেই।

মোস্তফা সাহেব ১ কোটি ৬১ লাখ ৪ হাজার ৩০০ টাকার যে হিসাবটা দিয়েছেন, সেটাও সঠিক নয়। বর্তমান পেনশন পদ্ধতিতে একজন অধ্যাপক (১ম গ্রেড) ‍যদি অবসরে যান, তিনি যে পেনশন-সুবিধাটা পাবেন, তা হলো তাঁর মূল বেতনের (৭৮০০০ টাকা) ৯০ শতাংশের ২৩০ গুণ।

অর্থাৎ ৭৮০০০ x৯০ x ২৩০ = ১,৬১, ৪৬০০০ টাকা। এই টাকার অর্ধেক ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পাবেন এককালীন।

কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে আসা মোস্তফা সাহেব শিক্ষকদের অবসরকালীন বয়স ৬৫ থেকে ৬০ করা নিয়ে বলেছেন, ‘একটা সুবিধা দিলে সেই সুবিধা কার্টেইল (কমিয়ে ফেলা) করা যায় না।’ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন, আজকের হিসাবে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৭ টাকার সুবিধা বন্ধ করে ৫ হাজার ৪৪৫ টাকার সুবিধা দেওয়াটা কি ‘সুবিধা কার্টেইল’ নয়?

বাকি অর্ধেক মাসিক ৩৫ হাজার ১০০ টাকা করে আজীবন এবং পেনশনারের মৃত্যুর পর তাঁর নমিনি আজীবন।

এই টাকার পাশাপাশি মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা করে চিকিৎসা ভাতা, বছরে দুটি বোনাস এবং একটি বৈশাখী ভাতা পাবেন।

এই ৩৫ হাজার ১০০ টাকা আবার প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়তে থাকবে। মোস্তফা সাহেব তাঁর হিসাবের মধ্যে এই ইনক্রিমেন্টকে হিসাবেই নেননি।

যদি এই ইনক্রিমেন্টসহ হিসাব করা হয়, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় একজন পেনশনারের ১৫ বছর পর সর্বমোট প্রাপ্তি হবে প্রায় ১ কোটি ৯৮ লাখ ১৮৮ টাকা।

যদি টাকার সময়মূল্য হিসাব করা হয় তাহলে এই ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকার আজকের দিনে ৫ হাজার ৪৪৫ টাকা। পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে এই লেখাটা শেষ করি।

কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে আসা মোস্তফা সাহেব শিক্ষকদের অবসরকালীন বয়স ৬৫ থেকে ৬০ করা নিয়ে বলেছেন, ‘একটা সুবিধা দিলে সেই সুবিধা কার্টেইল (কমিয়ে ফেলা) করা যায় না।’

কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন, আজকের হিসাবে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৭ টাকার সুবিধা বন্ধ করে ৫ হাজার ৪৪৫ টাকার সুবিধা দেওয়াটা কি ‘সুবিধা কার্টেইল’ নয়?

  • একরামুল হুদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক