২৫ বছর আগে থেকে যখন প্রথম আলো পাঠকদের হাতে পৌঁছাতে থাকে, তাঁরা বুঝেছিলেন এ পত্রিকা আর দশটা পত্রিকা থেকে ভিন্ন এক পথ কাটতে চাইছে। ছাপার মান ও গ্রাফিকস থেকে নিয়ে সংবাদের তথ্যনিষ্ঠতা, সম্পাদকীয় ও মতামত কলাম থেকে নিয়ে সাপ্তাহিক নানা ফিচার পাতায় নতুনত্ব এবং এর দৃষ্টিভঙ্গিগত একাগ্রতা পাঠকদের এ উপলব্ধিকে সমর্থন দিয়েছে।
প্রথম আলোর একটি বড় শক্তি সংবাদকর্মীদের তারুণ্য এবং নতুন ধারার সাংবাদিকতা চর্চার জন্য তাঁদের প্রত্যয়। তখনো দেশটির গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের এক দশকও হয়নি কিন্তু জাতীয় সংসদ তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, অর্থনীতির পালে হাওয়া লেগেছে এবং তরুণদের ভেতর দেশ নিয়ে একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। তাঁরা ভাবছেন, বাংলাদেশও পারবে। তাঁদের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন শক্তিশালী হয়। প্রথম আলো সেই প্রত্যাশা ধারণ করে তার কাজ শুরু করেছিল।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসটি নিরবচ্ছিন্ন নয়। সামরিক ও ছদ্মবেশী সামরিক শাসন এবং নানা কালাকানুনের বেড়াজালে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়েছে। সে জন্য গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর এর চর্চায় অনেক অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল, অথচ এসব অপূর্ণতা কাটিয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা সরকার বা দলগুলোর ভেতর তীব্র ছিল না। প্রশাসন ও পুলিশের কাজকর্ম, বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই বিচ্যুতি ছিল, যা গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। তরুণেরা চেয়েছিলেন এসব বিচ্যুতি থেকে দেশ বেরিয়ে আসুক। সেই প্রত্যাশা প্রথম আলো প্রতিফলিত করছিল।
আমাদের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতার চর্চা যাতে হয়, সে জন্য এর সম্পাদকীয়তে দিনের পর দিন আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। উপসম্পাদকীয় বা মতামত কলামগুলোয় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে; সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসনের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে; দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস ও ছোট-বড় নানা অনিয়ম নিয়ে সংবাদপত্রটি প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশ করেছে। ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব যেখানে ঘটেছে, এর অনুসন্ধানী আলো সেখানে পড়েছে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদ যখনই ফণা তুলেছে, সংবাদপত্রটি তা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি, বনাঞ্চল ও নদী দখল থেকে নিয়ে পরিবেশদূষণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাবেচা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণকারী ‘সিন্ডিকেট’গুলোর অপতৎপরতা, ব্যাংক লোপাট, মাদক ব্যবসার বিস্তারসহ এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে প্রথম আলো অব্যাহতভাবে তার পাতাগুলো ভরে রাখেনি। এসব মন্দের সঙ্গে ভালোর ওপরও আলো ফেলেছে প্রথম আলো। সমাজে ভালো কাজ যেখানে হয়েছে, তরুণদের হাত ধরে যেখানে শুভ কোনো কিছুর সূচনা হয়েছে, সংবাদপত্রটি তাকে অভিনন্দিত করেছে।
স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, সামাজিক সুরক্ষা অথবা খেলাধুলা—এ রকম অনেক বিষয় নিয়ে শুরু থেকেই সংবাদপত্রটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে আসছে, যেখানে বিশেষজ্ঞ ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের আলোচনার সারাংশ পাঠকদের জন্য ছাপা হয়েছে। প্রথম আলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি অবহিত, সক্রিয়, অধিকারসচেতন ও পরিবর্তনকামী নাগরিক সমাজ তৈরিতে সহায়তা করা, যারা গণতন্ত্রের বিকাশে ভূমিকা রাখবে।
সব ক্ষেত্রেই যে প্রথম আলো সাফল্য অর্জন করেছে, মোটেও তা নয়। আমাদের মতো দেশে তা সম্ভবও নয়, কারণ, এর পাঠক সংখ্যা। এখনো দেশের জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষাপ্রাপ্তের সংখ্যা খুবই সীমিত। তা ছাড়া করপোরেট-শাসিত, পুঁজি-নির্দেশিত একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যার প্রতিফলন পড়ে সমাজে, শিক্ষায় ও জীবনের সব ক্ষেত্রে, সুনীতি ও সুচিন্তায় উৎসাহ সীমিতই থাকে। তারপরও সংবাদপত্রটি তার পাঠক ও সমালোচকদের আগ্রহের কেন্দ্রে আসতে পেরেছে, এ প্রাপ্তিও কম নয়।
যেদিন প্রথম আলো অনলাইনেও প্রকাশ হতে লাগল, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষের কাছে তা পৌঁছে যেতে থাকল। অনলাইন সংস্করণের কয়েকটা সুবিধা পাওয়া গেল, যেমন এটি ২৪ ঘণ্টার কাগজ হয়ে গেল, এর পরিসর বাড়ানো এবং স্থির ও ভিডিও ছবির সমাহার ঘটানো সহজ হলো, সংবাদপত্রটির একটি আর্কাইভ সৃষ্টি হলো, যা ব্যবহারের সুযোগ সব পাঠকের জন্য থাকল। পাঠকেরাও নানা বিষয়ে তাঁদের মতামত জানানোর সুযোগ পেলেন।
প্রথম আলো একসময় দিনবদলের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করল। ‘বদলে দাও বদলে যাও’ স্লোগানটি একটি চমৎকার স্লোগান, কিন্তু কোনো সংবাদপত্রের পক্ষে এই বদলের শক্তিশালী অনুঘটক হওয়া সম্ভব নয়। এই বদল সম্ভব শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে শিক্ষার সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির শিক্ষা দিয়ে। আমাদের সন্তানদের এখন যে শিক্ষা আমরা দিচ্ছি, তা তাদের চাকরিজীবী হতে সহায়তা করে, কিন্তু সত্যিকারের ‘সম্পূর্ণ মানুষ’, যা ইউরোপ ও আমাদের মধ্যযুগে ঘটে যাওয়া রেনেসাঁসের মূল উপজীব্য ছিল, সেই হিসেবে গড়ে তুলতে একেবারেই অপারগ।
একইভাবে যে সংস্কৃতি মানুষকে নান্দনিক হতে শেখায়, জগৎ ও প্রকৃতির সঙ্গে তাকে মেলায়, সেই সংস্কৃতি এখন অবহেলিত, অচর্চিত। তাহলে মানুষ বদলাবে কীভাবে? সমাজ বা রাজনীতিতেই-বা কীভাবে পরিবর্তন আসবে? তবে সন্দেহ নেই, বদলে দেওয়ার আগ্রহ প্রথম আলোকে সক্রিয় করেছে এবং এটি হয়তো অনেককেই, যারা সত্যিকার পরিবর্তন আনতে সক্ষম, তাদের অনুপ্রাণিত করছে।
পাশাপাশি এটাও মানতে হবে, অনেক সময় প্রথম আলোর কোনো কোনো প্রতিবেদনে হয়তো কেউ পক্ষপাতিত্ব দেখতে পেয়েছেন অথবা কোনো ইস্যুতে অতি উৎসাহ। এ রকম উদাহরণ দু-একটি থাকলেই একটা সংকট তৈরি হয়। সে রকম হলে ভালো কাজগুলো চাপা পড়ে যায়। যেমন প্রথম আলো যে প্রথম দিন থেকেই অব্যাহতভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও প্রেরণাকে তার কাজের ভেতর রাখার চেষ্টা করেছে, তা হয়তো উপেক্ষিত থাকবে।
আমাদের মনে আছে, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের আঁকা একটি কার্টুন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বজাতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো লোকগুলোর প্রতি মানুষের ঘৃণা জাগিয়েছিল (দুঃখের বিষয়, এখন কোনো কার্টুন ছাপতেও পত্রিকাগুলোকে দুবার ভাবতে হয়, যা গণতন্ত্রের পথে আমাদের পিছিয়ে পড়াকেই নির্দেশ করে)। সংবাদপত্রের একজন পাঠক হিসেবে, মুক্তবুদ্ধিচর্চায় বিশ্বাসী একজন নাগরিক হিসেবে, তরুণদের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে অবহিত একজন শিক্ষক হিসেবে, আমি চাই, প্রথম আলোসহ আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলোর দায়িত্ব পালনের জন্য পরিস্থিতি যেন অনুকূল থাকে। সংবাদপত্রকে প্রতিপক্ষ না ভেবে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের পক্ষের একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে শেষবিচারে এর সুফল পায় দেশ ও দেশের মানুষ।
তবে এ কথাও মানতে হবে যে একটি সংবাদপত্র সব সময় তথ্যের সঠিকতা বজায় রাখতে পারে না বা তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কিছু ফাঁক থেকে যেতে পারে, কিন্তু সে জন্য প্রেস কাউন্সিল এবং অভিযোগ গুরুতর হলে আদালত আছেন। প্রথম আলোকে আরও সজাগ থাকতে হবে, যাতে সত্য ও তথ্যনিষ্ঠতা থেকে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কোনো ঘাটতি যেন না থাকে। এগুলো মাথায় রেখে সংবাদপত্রটি যদি এগোয়, তার চলার পথটিকে উন্মুক্ত রাখার দায়িত্ব থাকবে সবার।
২.
প্রথম আলো থেকে আমি বিশাল বাংলার জীবনের আরও প্রতিফলন চাই। সারা দেশে তরুণেরা যেভাবে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রকাশ দেখাচ্ছেন, নারীরা অনলাইনে ছোটখাটো নানা উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, সেসব নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন চাই। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনার আরও সংবাদ চাই, যাতে সেসবের প্রতিকার হয়। স্কুল-কলেজের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল হলে কেন ঢাকার কৃতী শিক্ষার্থীদের আনন্দ আর উদ্যাপনই দেখাতে হবে প্রথম পাতায়? দারিদ্র্য ও অবহেলার
কারণে যারা কৃতকার্য হতে পারে না, তাদের কথা কেন শোনানো হয় না?
আমি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি প্রথম আলোর আরও সমর্থন আশা করি। একসময়ের চার পাতার সাহিত্য সাময়িকী এখন এক-দেড় পাতায় এসে দাঁড়িয়েছে। এটিকে চার পাতায় কেন ফেরানো যাবে না? শিক্ষার্থীদের জন্য নোটবইসুলভ প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি নিয়ে একটি পাতা কেন থাকবে, যেখানে সরকার শিক্ষাকে সৃজনশীল করার উদ্যোগ নিচ্ছে?
প্রতিবছর আগের বছরের ত্রুটিবিচ্যুতি এবং পাঠকের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিগুলো খতিয়ে দেখে পরের বছরের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করুক সংবাদপত্রটি।
২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রথম আলো পরিবারের সবাইকে অভিনন্দন ও শুভকামনা।
● সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ