ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ডুবেছে উপকূলের অনেক এলাকা। আর তুমুল বৃষ্টিতে ডুবেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরের অনেক এলাকা। চট্টগ্রাম নগরীর কথা তো বলতেই হয় আলাদাভাবে।
এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই যেখানে অর্ধেক নগর তলিয়ে যায়, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে কী পরিস্থিতি হয়েছে, সেটি বোঝার নিশ্চয়ই আর বাকি থাকে না। ফলে গতকাল সোমবারের সারা দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম আর শহর ছিল না, এর একেকটি এলাকা হয়ে গেছে বৃষ্টি আর নালা-নর্দমার পানিতে একাকার একেকটি সমুদ্র।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো চট্টগ্রামের জলে ডোবা সড়কগুলো চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, যথারীতি ডুবে গেছে সিডিএ সড়ক, দুই নম্বর গেট, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, মুহাম্মদপুর, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, চকবাজার, কাপাসগোলা, বাদুড়তলা, কাতালগঞ্জসহ অনেক এলাকা।
এলাকায় এলাকায় অলিগলিতে টইটম্বুর পানিতে ডুবে গেছে বাসাবাড়ির নিচতলা। খাটের ওপর চেয়ার-টেবিল তুলে তার ওপরে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। দোকান, গুদাম, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার টাকার মালপত্র।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া শুধু একটি ভিডিওই সাক্ষ্য দেয়, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কী চরম আকার ধারণ করেছিল গতকাল।
স্থানীয় এক সাংবাদিকের করা সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুরো সড়কে বুকসমান পানি। পানিতে আটকে পড়েছে অনেক রিকশা। রিকশায় বসার আসন ছুঁই ছুঁই পানি। যাত্রীরা বসার আসনে উঠে বসেছেন। কয়েক হাত দূরত্বে দেখা যাচ্ছে পানি মানুষের গলা ছুঁয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকের বর্ণনা থেকে জানা গেল, জায়গাটা মুরাদপুর এলাকায় উড়ালসড়কের নিচের রাস্তায়। মুহাম্মদপুরের মাজারের সঙ্গে।
একই সড়কের ১৫০ থেকে ২০০ মিটার দূরের পরিস্থিতি নিয়ে একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পেজ থেকে।
বৃষ্টিতে ভেজা পিচঢালা সড়কের একটি ছবি দিয়ে ক্যাপশনে মেয়র লিখেছেন: ‘মুরাদপুর ফ্লাইওভারের পাশের সড়কটি অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যেত, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়কটি বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে, পানি চলাচলের জায়গা প্রশস্ত করি। নতুন করে সংস্কার করার পর বন্যা হলেও পানি খুব দ্রুত নেমে যায়। আজকের এই চিত্র।’
অথচ বারকোড ফুড জংশনের সামনে সড়কের এ অংশকে দুই ভাগ করেছে ফ্লাইওভারের নিম্নাংশ। এর এক পাশ পানিতে ডুবে ছিল কিনা বোঝা না গেলেও অন্য পাশের ছবি দিয়ে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সফলতার কাহিনি ফেঁদেছেন মেয়র সাহেব। যদিও এর ১৫০ থেকে ২০০ মিটার আগে-পরে ঠিকই পুরো সড়ক পানিতে ডুবে যায়, যা স্থানীয় সাংবাদিকের ভিডিওতেই দেখা গেছে। আর সব সংবাদমাধ্যমের খবরাখবরে তো তা উঠেই এসেছে।
একটি ফটোগ্রাফ বা স্থিরচিত্র সব সময় সত্য বলে না। সেই ছবি তোলার সময় ও তার আগে-পরের বাস্তবতা ও পরিস্থিতি একটি অবশ্য বিবেচ্য বিষয়। একটি ছবি কতটা ভুল ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ ও উদাহরণ আছে। ফেসবুকে মেয়র রেজাউলের পেজে পোস্ট করা ছবিটিও এর একটি উদাহরণ।
ছবি শুধু ইল্যুশন বা মায়াই তৈরি করে না, ধোঁকাবাজি বা বিভ্রান্তিও তৈরি করতে পারে। ছবিটির মাধ্যমে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি নিয়ে আসলে সেই বিভ্রান্তিই তৈরি হয়েছে বলে মনে করতে পারেন অনেকে।
গতকাল মেয়র সাহেব তাঁর ফেসবুক পেজে নগর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নানা তৎপরতা নিয়ে নানা পোস্ট দিলেও সেখানে ঠাঁই পায়নি জলাবদ্ধতায় হাবুডুবু খাওয়া নগরবাসীর কষ্ট। গতকালও খালে পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে, আছদগঞ্জ এলাকায়। আরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মেয়র সাহেব কি তাঁদের পরিবারের কাছে যাবেন, অন্তত সান্ত্বনা দিতে হলেও?
যাঁরা চট্টগ্রামবাসী নন, তাঁদের কাছে ছবিটি দেখতে সুন্দর লাগতে পারে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন ও মেয়র সাহেব কতটা অন্তঃপ্রাণ, সে সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাও পেতে পারেন।
হাজার হাজার চট্টগ্রামবাসী যখন দুর্ভোগে নাকাল, তখন মেয়র সাহেবের এমন পোস্ট ভালোভাবে নেবেন না, সেটিই স্বাভাবিক। ফলে সেই পোস্টের নিচে অসংখ্য মানুষ এসে সমালোচনা করেছেন। দুই হাজারের বেশি মন্তব্য পড়েছে পোস্টটির নিচে, যার অধিকাংশই মেয়র সাহেবের সমালোচনা, বিদ্রূপ ও গালিতে ভরপুর।
সেখান থেকে কয়েকটি নমুনা দেওয়া গেল—‘জলাবদ্ধ শহরবাসীর সাথে তামাশা না করে বাসায় গিয়ে ঘুমান।’, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ মেয়র সাহেব আপনার কি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নাই? আপনি কি আজকের হালচাল দেখছেন না?’, ‘গত তিন বছরের উন্নয়ন কি এই রাস্তা? পানি কি অন্য কোথাও আর উঠে নাই? কয়টা এলাকায় গিয়েছেন খোঁজ নিতে?’, ‘রেজাউল ভাই, গালি এমনে জনগণ দিচ্ছে শুনে যেতেন, এই ছবিটা দিয়ে তো গালির মাত্রাটা বাড়ালেন!’
আরও কিছু মন্তব্য পাওয়া যায় এমন—‘মেয়র সাহেব, আপনার বাসার সামনে কী অবস্থা? এসব কথা বলতে লজ্জা করে না?’, ‘পুরো মুরাদপুর পানির নিচে আর উনি আসছে উন্নয়নের ছবক দিতে।’, ‘হাস্যকর পোস্ট, কিছুক্ষণ আগে দেখে আসলাম মানুষ ডুবে যাচ্ছে পানিতে।’, ‘সিঙ্গাপুরের বাকি এলাকার কী অবস্থা?’, ‘মাননীয় মেয়র মহোদয়, আপনার উন্নয়ন দেখে ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না, স্যালুট!’, ‘পুরো চট্টগ্রাম শহরের চিত্র তুলে ধরুন। একটি ফ্লাইওভারের সড়কের ছবি আপলোড করে নগরবাসীকে সান্ত্বনা দিয়ে কী হবে, আমরা তো সবাই ভুক্তভোগী।’ আবার অনেকে এমন মন্তব্যও করেছেন, পানি নেমে যাওয়ার পর বিকেলে চকচকে রাস্তার এ ছবি তোলা হয়েছে।
গতকাল সকাল সাতটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত অন্তত সাত ঘণ্টা জলাবদ্ধ ছিল চট্টগ্রাম নগর। জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছিলেন অফিস ও কর্মস্থলমুখী লোকজন। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়কে গাড়ির পরিমাণও ছিল কম। কোথাও কোথাও মাঝপথে গাড়ি আটকে গিয়ে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়।
গতকাল মেয়র সাহেব তাঁর ফেসবুক পেজে নগর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নানা তৎপরতা নিয়ে নানা পোস্ট দিলেও সেখানে ঠাঁই পায়নি জলাবদ্ধতায় হাবুডুবু খাওয়া নগরবাসীর কষ্ট। গতকালও খালে পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে, আছদগঞ্জ এলাকায়। আরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মেয়র সাহেব কি তাঁদের পরিবারের কাছে যাবেন, অন্তত সান্ত্বনা দিতে হলেও?
চট্টগ্রামবাসীকে সাত ঘণ্টা ভুগিয়ে বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে বেশির ভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে যায়। তবে সড়ক উঁচু করার কারণে অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতে যে পানি ঢুকে গেছে, তা ভোগান্তি বাড়িয়েছে আরও বেশি। চট্টগ্রামের মেয়ররা সড়কের পানি দ্রুত নামিয়ে দেওয়াকেই যে জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসন ভাবছেন, তাতে গলদ আছে। মেয়র সাহেবের পোস্টেই একজন নগরবাসী এমন মন্তব্য করেছেন, ‘রাস্তা উঁচু করে করে জনগণের বাড়িঘরে পানি আজ, জনগণের দুর্ভোগ কমাতে গিয়ে রাস্তা অপরিকল্পিতভাবে উঁচু করে আপনি আরও দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিলেন।’
৬ মে মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেও তলিয়ে গিয়েছিল শহরের অনেক এলাকা। তীব্র তাপপ্রবাহ শেষে স্বস্তির বৃষ্টি হয়ে উঠেছিল আরও বেশি দুর্ভোগের। তবে গতকাল পানি জমলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নেমে গেছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ হিসেবে বলছেন, এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে প্রকল্পের আওতায় খালগুলো খনন করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে উন্নয়নের শেষ নেই। ৫ থেকে ১০ বছর ধরেও শেষ হয়নি ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের কয়েকটি প্রকল্প। ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও নগরের জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। ফলে বছরের যেকোনো সময়ে দু-এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা উঠলে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তখন ‘কথার ফুটবল’ ঠেলে দেয় একজন আরেকজনের দিকে।
এসব দেখতে দেখতেই নগরবাসী অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেখানে তাঁদের সঙ্গে ‘তামাশা’ করা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া নয় কি, মেয়র সাহেব?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।
ই–মেইল: [email protected]