একের পর এক ‘বোনাস’ যুক্ত করে পরিমাণ বাড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বোনাসের নামকরণেও বেশ অভিনবত্ব—‘গাইবান্ধা’, ‘জয়পুরহাট’, ‘হিলি’ থেকে ‘বাংলালিংক’, ‘সিটিসেল’, ‘বিকাশ’, ‘নগদ’। বেশ কায়দা করে বারবার ‘বোনাস’ শব্দ উচ্চারণের কারণেই বোধ করি পথচারীরা তাঁকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার হলেও ঘাড় কাত করে দেখছিলেন। নইলে দুই পাশে দুটি ছোট আকারের বস্তায় প্রায় তলানিতে থাকা কিছু পুরিয়া (কাগজ দিয়ে বানানো), মধ্যে ছোট টুলের ওপর বসা লুঙ্গি ও শার্ট পরা মলিন চেহারার লোকটি ‘বাড়তি’ মনোযোগ পায় না। কিন্তু পুঁজির বশে আস্ত দুনিয়াই যখন বাজারে পরিণত, তখন চটকদারি, দেখনদারি নতুবা শুনতে ভারী কিছু না হলে তো পণ্য বিকোয় না! লোকটি বুঝি তা উপলব্ধি করে থাকবেন, তাই ‘বোনাসের বন্যা’ বইয়ে দিচ্ছিলেন।
তিনি বিক্রি করছিলেন গরমমসলা, সঙ্গে জিরা। আগে থেকে বানানো গরমমসলার নানা পদ ও জিরার পুরিয়াগুলো একের পর খুলে ডান পায়ের ঊরুর ওপর একটাতে রাখছেন, আর বলছেন—‘এই হলো গাইবান্ধার বোনাস, এরপর হিলির অ্যাকখান বোনাস, এরপর মামা লন জয়পুরহাটের বোনাস...’
গরমমসলার ব্যবহার মূলত মাংসের বিভিন্ন পদে, পোলাও-বিরিয়ানিতে। এটি শুধু বাড়তি স্বাদই যুক্ত করে না, খিদে উদ্রেককারী ঘ্রাণও ছড়ায়, আর নানাবিধ গুণ তো রয়েছেই। কিন্তু গরিবের ব্রয়লার মুরগির দামও যখন নাগালের বাইরে যাচ্ছি যাচ্ছি করছে, তখন গরমমসলার কাটতি কি আগের মতো আছে? আর উনি যেভাবে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসেছেন, সুপারশপে বাজার করা লোকজন যে তাঁর ক্রেতা নন, তা না বললেও চলে। তাহলে?
নিজেই বললেন, বেচাবিক্রিতে ভাটার কথা। সাধারণত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদুল আজহার সময়। অন্য সময় টুকটাক সংসার চালিয়ে নেওয়ার মতো ব্যবসা হয়। কিন্তু এখন একটু ‘খরা ভাব’। অন্যের খাবারের স্বাদ, পুষ্টি ও গন্ধের উপাদান যিনি ফেরি করেন, সেই ফেরিওয়ালার জীবন যেন স্বাদ-গন্ধহীন।
গরমমসলার ব্যবহার মূলত মাংসের বিভিন্ন পদে, পোলাও-বিরিয়ানিতে। এটি শুধু বাড়তি স্বাদই যুক্ত করে না, খিদে উদ্রেককারী ঘ্রাণও ছড়ায়, আর নানাবিধ গুণ তো রয়েছেই। কিন্তু গরিবের ব্রয়লার মুরগির দামও যখন নাগালের বাইরে যাচ্ছি যাচ্ছি করছে, তখন গরমমসলার কাটতি কি আগের মতো আছে?
নাম মো. ফরিদুল ইসলাম। বয়স বললেন ২৬ কি ২৭। এসএসসি পাসের পর গ্রাম ছাড়েন। গাইবান্ধার পলাশপুর উপজেলার হরিনাথপুর থেকে সোজা চলে যান চট্টগ্রাম। সেখানে একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন কিছুদিন। কিন্তু চাকরি তাঁর কাছে ‘জেলখানার নাগান’। তাই এলাকার আরও যাঁরা নারায়ণগঞ্জের কালিরবাজার থেকে মসলা কিনে ঢাকার পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন, তাঁদের সঙ্গে ভেড়েন। নতুন ঠাঁই গাড়েন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া মোড়ের কাছের এক মহল্লায়। এখন সাতসকালে কালিবাজারে গিয়ে মালসামান কেনেন, পরে বাসে করে ঢাকায় চলে আসেন। সারা দিন এ পাড়া সে মহল্লায় বিক্রি শেষে রাতে ফিরে যান।
‘মামা, খরচাপাতির কথা আপনাক আর কী কমু’ বলে শুরু করলেন ফরিদুল। আগে চাষাঢ়া থেকে ঢাকার বাসভাড়া ছিল ৪৫ টাকা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর হয়েছে ৬০ টাকা। সারা দিন ঘুরলে পেটে দানাপানি কিছু দিতে হয়। কখনো যদি কোনো বাজারে বসেন তাহলে খাজনা দিতে হয়। আবার অনেক সময় কিছু দুর্বৃত্তও পথ আটকে ২০ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে নেয়। আরেক শ্রেণির লোকও মাঝেমধ্যে ‘ঝামেলা’ করার ভয় দেখিয়ে চা-বিস্কুটের খরচ নেন। আর বাজারে জিনিসপাতির দাম তো জানেনই।
‘মামা, বিকরিটা হইল ভাইগ্য’, বলে একটু থামেন ফরিদুল। জানালেন, স্ত্রী একটা গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তাই চলতে পারছেন। মেয়ের বয়স সাড়ে তিন বছর। তাঁদের বাসার পাশে ভাড়া থাকেন শাশুড়ি। তাঁর কাছে মেয়েকে রেখে তাঁরা দুজন বেরিয়ে পড়েন। তবে সপ্তাহের সাত দিনই ফেরি করা সম্ভব হয় না। মাসের সাত-আট দিন কামাই যায়। গড়ে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা থাকে। ঘরভাড়া ২ হাজার ২০০ টাকা। খাওয়াদাওয়া, কাপড়চোপড়। মেয়ের দুধ। চিকিৎসা।
‘কিছু থাকে না, মামা’, একটু যেন হতাশা ফরিদুলের কণ্ঠে; কান্তিও ঝরে পড়ল কি? ১৬ আগস্ট রাজধানীর হাজারীবাগে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সারা দিন ঘোরাঘুরি গেছে। তখনো তাঁর বস্তা শূন্য হয়নি; মালসামানা কিছু রয়ে গেছে।
বস্তা শূন্য না হওয়া মানে শ্রমজীবী মানুষটির পকেটও কিছুটা ‘শূন্য’ থাকবে। এই শূন্যতার সঙ্গে অনেক কিছুর যোগ—আহার, ঠাঁই, চিকিৎসা...যার অপর নাম বেঁচে থাকা। বোনাসের ‘অফার’ শুনে তাঁর দিকে অনেকেই নজর দেন, তাঁদের মধ্যে দু-চারজন পণ্যও কেনেন, কিন্তু বিক্রেতার ‘শূন্যতা’ কজন দেখতে পান?
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]