ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের অভিঘাত দুনিয়াজুড়ে নানা দেশের রাজনৈতিক জীবনের ওপরে প্রভাব ফেলেছে। এই যুদ্ধের প্রভাব যতটা না ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর ওপর পড়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে রাশিয়া-ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর ওপর। ইউক্রেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং রাশিয়া একটি প্রবলভাবে দুর্নীতিপ্রবণ উৎপীড়ক কর্তৃত্ববাদী দেশ। এ কারণে যুদ্ধটি দুটি পরস্পর বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক আদর্শের মৌলিক সংঘাতকেই সামনে আনছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বেগের বিষয়, কারণ এই যুদ্ধে গণতন্ত্রের সামরিক পরাজয় বিশ্বের অন্য অঞ্চলের স্বৈরশাসকদের কাছে অনুরূপ সামরিক অভিযানের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করতে পারে। সৌভাগ্যের বিষয়, যুদ্ধ যতই প্রলম্বিত হচ্ছে, ইউরোপে জনতুষ্টিবাদের আভা ততই ফিকে হচ্ছে। কারণ, রাশিয়ার বিজয়ের সম্ভাবনা গোটা ইউরোপকে একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।
রাশিয়াপন্থী জনমোহিনীবাদীরা যখন কোণঠাসা অবস্থায় যেতে শুরু করেছেন, তখন ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া মধ্যপন্থীদের স্বাগত জানানো হচ্ছে; যদিও এসব মধ্যপন্থী নেতারা তাঁদের নিজেদের দেশে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন ও খর্ব করে বসে আছেন। উদাহরণ হিসেবে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদার কথা বলা যায়। রাশিয়ান আগ্রাসনের আগে দুদাকে পশ্চিমের সবখানেই অত্যন্ত শীতলভাবে গ্রহণ করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন তাঁকে ট্রান্স আটলান্টিক এবং ইউরোপীয় বৈঠকগুলোতে একজন প্রধান অংশগ্রহণকারীতে এবং জনতুষ্টিবাদবিরোধী পশ্চিমা রাজনীতিকদের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত করেছে। একই সঙ্গে দুদা নিজেও আগের চেয়ে কম জনতুষ্টিবাদী হয়ে উঠছেন।
দুদা কখনোই স্বাধীন চিন্তাধারার রাজনীতিবিদ ছিলেন না। পোল্যান্ডের ল অ্যান্ড জাস্টিস (পিআইএস) পার্টির প্রধান জারোস্লাভ কাচজিনস্কির হাত ধরে তাঁর উত্থান এবং কাচজিনস্কির বদৌলতেই তিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন। কিন্তু এখন তিনি কাচজিনস্কির কথা না শুনে আমেরিকান দূতাবাসের ইঙ্গিতের দিকে চেয়ে থাকেন। দুদা মনে করছেন, আমেরিকানরা তাঁকে যা দিয়ে পুরস্কৃত করতে পারবে, কাচজিনস্কি তা তাকে দিতে পারবেন না।
পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ২০০টির বেশি ট্যাংকসহ সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং তারা ঘোষণা করেছে, তারাই হবে জার্মান লেপার্ড ২ এস ট্যাংক আধুনিকায়ন করা প্রথম দেশ। অন্যদিকে, হাঙ্গেরি শুধু ইউক্রেনকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেনি, বরং দেশটি তার সরকার-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে রাশিয়ান প্রচার চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ, ওয়ারশ এবং বুদাপেস্টের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে গেছে। কাচজিনস্কি সরাসরি ওরবানের সমালোচনাও করা শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে রাশিয়াপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা প্রায় সবখানেই সমর্থন হারাচ্ছে। তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হাঙ্গেরির ভোটারদের বোঝাতে পেরেছেন যে রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাতুর্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে তাঁরা সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করতে পারবেন। কিন্তু এখন এমনকি ওরবানকেও আপসের সুরে কথা বলতে হয়েছে। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলোকে অমান্য করার সাহস দেখাননি; কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, তাঁর আইন লঙ্ঘনের ফলে আটকে রাখা কোভিড পুনরুদ্ধার-প্যাকেজ তহবিল পেতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভালো আচরণ করতেই হবে।
ওরবান এমন এক অচলাবস্থায় রয়েছেন, যেখানে তিনি না একজন একঘরে নেতা; না তিনি ওয়াশিংটন, লন্ডন বা এমনকি বার্লিনের নেতাদেরও সঙ্গী বা অংশীদার। তবে আগের সেই কাচজিনস্কি-ওরবান চক্র এখন আর সক্রিয় নেই।
পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ২০০টির বেশি ট্যাংকসহ সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং তারা ঘোষণা করেছে, তারাই হবে জার্মান লেপার্ড ২ এস ট্যাংক আধুনিকায়ন করা প্রথম দেশ। অন্যদিকে, হাঙ্গেরি শুধু ইউক্রেনকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেনি, বরং দেশটি তার সরকার-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে রাশিয়ান প্রচার চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ, ওয়ারশ এবং বুদাপেস্টের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে গেছে। কাচজিনস্কি সরাসরি ওরবানের সমালোচনাও করা শুরু করেছেন।
এদিকে ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের প্রবেশ নিশ্চিত করতে পশ্চিমা নেতাদের অবশ্যই এরদোয়ানকে লাগবে এবং তুরস্ক যাতে রাশিয়ার কাঁচামাল, পণ্য এবং প্রযুক্তির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় যোগ না দেয়, সে জন্য ক্রেমলিনকে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে হবে।
এসব বিবেচনায় মনে হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার এখন পর্যন্ত সামরিক জয় না পাওয়ার প্রভাবে বিশ্বব্যবস্থায় একটি ভারসাম্যমূলক পরিবর্তন আসছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো