যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচনী দৌড় শুরু করেছেন। শুরুতেই তিনি ‘অবিচার বিভাগের “ঠগদের” আক্রমণ করেছেন’। বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে ‘বিভ্রান্ত-পাগল’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত হওয়ায় এবং হোয়াইট হাউসে প্রবেশের দৌড়ে বাধা সৃষ্টি হওয়ার ঘটনাকে তিনি ‘আমেরিকার জন্য শেষ যুদ্ধ’ বলে মনে করছেন।
জর্জিয়ায় রিপাবলিকান পার্টির সমাবেশে বক্তৃতাকালে ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার পুরো বিচার বিভাগ ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর বিজয় ঠেকাতে নিয়োজিত। তিনি বলেন, ‘এসব লোক থামে না এবং তারা খারাপ এবং তাদের কাছ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। এসব অপরাধী পুরস্কৃত হতে পারে না। তাদের অবশ্যই পরাজিত করতে হবে।’
ট্রাম্প আবারও আমেরিকানদের পক্ষ বেছে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিভ্রান্ত মনে ‘শেষ যুদ্ধটা’ কেবল সাধারণ অর্থে ‘খলনায়কদের’ বিরুদ্ধে নয়; বরং এই যুদ্ধ তাঁরা যাঁকে মহান বলে মনে করেন এবং যাঁরা তাঁকে ঘৃণা করেন, এই দুয়ের মধ্যকার যুদ্ধ।
নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রুথ সোশ্যালে শুক্রবার রাতে এক পোস্টে অনুসারীদের উদ্দেশে ট্রাম্প লেখেন, ‘মঙ্গলবার মায়ামিতে দেখা হবে!’
ট্রাম্পের এই আহ্বান ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেদিন টুইটে তিনি বলেছিলেন, ‘সেখানে থেকো, উন্মত্ত হয়ে ওঠো!’ ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে উগ্রপন্থীরা যে উন্মত্ত আচরণ করেছিলেন, তাতে প্রেরণা জুগিয়েছিল সেই টুইট।
কিন্তু এর কোনো কিছুতেই আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প এখন অন্য যেকোনো সময়ের বেশি উন্মাদ ও বিপজ্জনক। এর আগে সহিংসতার আগুনে ঘি ঢেলেছেন তিনি। আবারও তিনি সেটা করতে পারেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হলো, ২০২০ ট্রাম্পকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর পাগলামি ধরে ফেলেছেন।
জর্জিয়ায় রিপাবলিকানদের সম্মেলনে শুক্রবার রাতে অ্যারিজোনার রিপাবলিকান নেতা কারি লেক উপস্থিত ছিলেন। ট্রাম্পকে সমর্থন জানাতে মায়ামিতেও তিনি যাবেন। তিনি সহিংসতার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। ‘কেউ যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে আসতে চায়, তাহলে তাকে আগে আমার কাছে আসতে হবে, আমার মতো সাড়ে সাত কোটি আমেরিকানের সামনে দিয়ে আসতে হবে।’ জর্জিয়ায় লেক যখন এ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন ট্রাম্পের সমর্থকেরা গর্জন করছিলেন আর দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন।লেক বলেন, ‘আমরা বেশির ভাগই এনআরএ (ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন) কার্ডধারী সদস্য। এটা নিছক হুমকি নয়, এটা আমাদের প্রকাশ্য ঘোষণা।’
আইনসভার বেশির ভাগ রিপাবলিক পার্টির সদস্য আবারও ট্রাম্পের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ালেন না। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যে সহিংসতার পক্ষে উসকানি দিচ্ছেন। কংগ্রেসে লুজিয়ানার প্রতিনিধি ক্লে হিগিনস গেরিলা যুদ্ধের কথা বলেছেন। সামনের কাতারে থাকা বেশির ভাগ রিপাবলিক পার্টির কংগ্রেসম্যান—তাঁদের মধ্যে যাঁরা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মনোনয়ন চান—তাঁরাও বিচার বিভাগকে ‘অস্ত্রে’ পরিণত করার অভিযোগে বাইডেন, মেরিক গ্যারল্যান্ড ও বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথের সমালোচনা করছেন।
এর সবকিছুই জোর করে আমেরিকানদের একটা পক্ষ বেছে নেওয়ার ট্রাম্পের যে লক্ষ্য, তাতে ইন্ধন দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা হতে পারে, কিন্তু গৃহযুদ্ধ ঘটার সম্ভাবনা নেই।
কোনো নেতাকে পছন্দ করা কিংবা ঘৃণা করার ওপর ভিত্তি করে আমেরিকানরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন না। তাঁরা নেতাদের মতাদর্শ, ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক শ্রেণি ও অর্থনৈতিক নীতির কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
ট্রাম্প এখন এমন এক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছেন, যেটি তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। সেই ব্যবস্থাই এখন আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাঁকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে চলেছে।
উপরন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনের পর প্রথম দফায় ট্রাম্প আমেরিকার গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া রক্ষাপ্রাচীরগুলোকে (যেমন আদালত, রাজ্যগুলোর নির্বাচনী কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ) পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। এখন সেগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী।
ক্যাপিটল হিল তছনছের ঘটনায় যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা অনেকেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যেসব প্রার্থী নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। আদালতগুলো ফেডারেল কৌঁসুলিদের দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত যুক্তি তুলে ধরতে ট্রাম্পের কৌঁসুলিরা সমস্যায় পড়বেন। অভিযোগ অনুযায়ী, আমেরিকার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি করতে পারে, ট্রাম্প অবৈধভাবে এমন নথি নিজের কাছে রেখেছিলেন (কিছু কিছু ক্ষেত্রে নথি অন্যের সঙ্গেও ভাগাভাগি করেছিলেন)। এসব নথির মধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচি, সামরিক হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের বড় দুর্বল জায়গা, বিদেশি হামলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বদলার মতো নথি রয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে ‘হামলার পরিকল্পনা’, এ ধরনের একটি নথি হাতবদলের অভিযোগও রয়েছে।
রিপাবলিকানরা মনে করেন, জাতীয় নিরাপত্তা তাঁদের কাছে সবচেয়ে উচ্চতম ও পবিত্র কর্তব্য। এ কারণেই রিপাবলিকানদের একটা বড় অংশ সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করে।
ট্রাম্পের নিজস্ব অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বার গত রোববার ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘এই নথিগুলো এমন মাত্রায় স্পর্শকাতর এবং সংখ্যায় এত যে খুব খোলাখুলিভাবে বললে...এমনকি এগুলোর অর্ধেকটাও যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি বেকায়দায় পড়বেন। আমি বোঝাতে চাইছি, এটা অনেক বিস্তারিত অভিযোগ এবং অনেক, অনেক ভয়াবহ। এখানে ট্রাম্পকে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করা হাস্যকর।’
কিন্তু এর কোনো কিছুতেই আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প এখন অন্য যেকোনো সময়ের বেশি উন্মাদ ও বিপজ্জনক। এর আগে সহিংসতার আগুনে ঘি ঢেলেছেন তিনি। আবারও তিনি সেটা করতে পারেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হলো, ২০২০ ট্রাম্পকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর পাগলামি ধরে ফেলেছেন।
ট্রাম্প তাঁর নিজের অভিলাষ পূরণের খায়েশে আমেরিকানদের ‘শেষ যুদ্ধে’ জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন। এর পরিবর্তে, তিনি শেষ পর্যন্ত অপমানই পাবেন।
রবার্ট রাইক, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমমন্ত্রী এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জননীতি বিষয়ে অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে