উন্নয়নের জন্য ডেটার ব্যবহার করা যাবে কীভাবে

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তরুণদের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি। এই সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ডেটার সঠিক ব্যবহার দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

ডেটা দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ


ডেটার ব্যবহারে আমাদের উদাসীনতা ও ডেটা ঘাটতি প্রকট। আজ আমরা সঠিকভাবে এক্সপোর্ট বা ইমপোর্টের হিসাব করতে পারি না, এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও একাধিকবার সংশোধন করতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্ভে ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতার অভাব দেখা যায়, যা উন্নয়নের সঠিক পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত করছে। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হলে আমাদের ডেটা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সামগ্রিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার


বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো ডেটার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নতি করছে। সরকার ও বিভিন্ন খাতে ডেটা ব্যবহার দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং সফল বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডেটার ব্যবহার নাগরিকদের ক্ষমতায়নের বড় সুযোগ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে সহজেই নাগরিকেরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং আর্থিক সেবা নিতে পারবে এবং জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ পাবে।

জাতীয় ডেটা স্ট্র্যাটেজি ও কর্মপন্থা

ডেটা সংগ্রহ, ব্যবহার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারকে একটি সুপরিকল্পিত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করা জরুরি:

১. ডেটা স্ট্র্যাটেজি ও আইনি কাঠামো
ডেটার সঠিক ব্যবহারের জন্য একটি কার্যকর ডেটা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।  নির্ধারণের জন্য দুটি দিক ভাবা দরকার। লক্ষ করা যায়, উন্নত দেশগুলোতে যেমন ইউরোপে ডেটার মালিকানা, প্রাইভেসি এবং নিরাপত্তা নিয়ে বেশি কাজ হয়েছে। আবার উন্নয়নশীল দেশ ভারতে ডেটা সংগ্রহ এবং শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে নাগরিকের ক্ষমতায়ন এবং জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

এ ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) একটি উদাহরণ হতে পারে, যা নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে মানদণ্ড তৈরি করেছে। এ ছাড়া আমরা অস্ট্রেলিয়ার ডেটা স্ট্র্যাটেজি, সিঙ্গাপুরের ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট ২০১২ এবং ভারতের প্রাইভেসি অ্যান্ড প্রটেকশন অ্যাক্ট ২০২৩ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

২. ডেটা আর্কিটেকচার এবং শেয়ারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার
ডেটা সুরক্ষিতভাবে সংগ্রহ ও শেয়ার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো প্রয়োজন, যেখানে তথ্য শেয়ার নাগরিকদের অনুমতির ওপর নির্ভর করবে। ডেটা শেয়ারিংয়ের জন্য গাইডলাইনের পাশাপাশি আমাদের একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার সিস্টেম প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনায় সরকারের আইসিটি ডিভিশন ডেটাচালিত সেবার বাস্তবায়নে মূল উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কের কাজ করতে পারে। তারা প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে।

ডেটা নিয়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এস্তোনিয়া তাদের ডিজিটাল আইডি এবং ই-গভর্নেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে নিরাপদ ডেটা শেয়ারিং নিশ্চিত করেছে, সিঙ্গাপুর একটি উন্নত ই-গভর্নেন্স সিস্টেম এবং ডেটা শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, আর ভারত ডেটা এম্পাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন আর্কিটেকচারের (ডিইপিএ) মাধ্যমে সম্মতিভিত্তিক ডেটা শেয়ারিং কার্যকর করেছে।

৩. ডেটা ম্যানেজমেন্ট এবং ব্যবহার
ডেটার সঠিক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের উদাহরণ দেওয়া হলো:

নাগরিক পরিচয় সেবা: একটি আধুনিক নাগরিক পরিচয় সেবা চালু করতে হবে। সব বয়সের সব নাগরিকের পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে এবং বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্র ডেটাবেজ এখানে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। নিরাপদ সেবা দেওয়ার জন্য এখানে নাগরিকের মোবাইল ফোন নম্বর সংযুক্ত করা যেতে পারে।

ড্যাশবোর্ড–ভিত্তিক মন্ত্রণালয় পরিচালনা: প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থা ডেটা ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যা তাদের কাজের অগ্রগতি ও বাজেট পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়াবে। এই সিস্টেম সরকারের কাজকে আরও জবাবদিহিমূলক করবে এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

ফিন্যান্সিয়াল ডেটা এক্সচেঞ্জ: ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে ডেটা বিনিময় চালু করতে একটি ফিন্যান্সিয়াল ডেটা এক্সচেঞ্জ তৈরি করা হবে। এর ফলে নাগরিকেরা সহজে আর্থিক সেবা নিতে পারবে এবং আরও মানুষ এই সেবার আওতায় আসবে।

ডেটাভিত্তিক লোন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম: সব ব্যাংক ঋণদানের আগে ডাটাভিত্তিক লোন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করবে। দেশে প্রাইভেট ক্রেডিট ব্যুরো স্থাপন করে নাগরিকদের এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রিপোর্ট এবং স্কোরিং তৈরি করা হবে। এতে ঋণের ঝুঁকি কমবে এবং কম খরচে ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে সব ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সেক্টরের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বাড়বে।

এখনই এগিয়ে যাওয়ার সময়

ডেটা বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। সঠিক নীতি, রোডম্যাপ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডেটার শক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারি। এ জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা যেতে পারে: (১) ডেটা ব্যবহারে নেতৃত্ব দিতে আইসিটি বিভাগে ডেটা এম্পাওয়ারমেন্ট সেল প্রতিষ্ঠা, (২) নাগরিক ক্ষমতায়ন ও নিরাপদ ডেটা শেয়ারিংয়ের জন্য ডেটা এম্পাওয়ারমেন্ট ও শেয়ারিং ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি, এবং (৩) আর্থিক সেবা সম্প্রসারণ ও অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় একটি ফিন্যান্সিয়াল ডেটা এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম চালু।

ডেটার সঠিক ব্যবহার প্রশাসনিক কাজকে সহজতর করবে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করবে এবং উন্নয়নের গতিকে বহুগুণে ত্বরান্বিত করবে। একটি উদ্ভাবনী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে ডেটানির্ভর ব্যবস্থাপনা এখন অপরিহার্য, এবং এখনই সময় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার।

  • ড. শাহাদাত খান একজন ফিনটেক উদ্যোক্তা এবং প্রফেশনাল, ট্যালিখাতা এবং ট্যালিপে-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।  [email protected]