হিটলারের মতো যে বিচারে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে

ডোনাল্ড ট্রাম্প

১৯২৪ সালের ১ এপ্রিল অ্যাডলফ হিটলারের আতঙ্কিত হওয়ার কথা ছিল। ওই দিনটির সাড়ে চার মাস আগে এই নাৎসি নেতা জার্মানির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী মিউনিখে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ইতালির ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হিটলার তাঁর উন্মত্ত সমর্থকদের নিয়ে বার্লিন অভিমুখে যাত্রা শুরু করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি সেখানকার গণতান্ত্রিক ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

১৯২৩ সালের ৮ নভেম্বর রাত আটটার খানিক পরে হিটলারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়। একটি রাজনৈতিক সমাবেশে হিটলার এবং তাঁর সমর্থকেরা প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং জনগণকে তাঁরা উন্মত্ত করে ফেলেন।

উন্মত্ত তাণ্ডবের সময় হিটলারের স্টারমাবটেইলুং (স্টর্ম ট্রুপারস) নামের সশস্ত্র বাহিনী তাদের বিরোধীদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভাঙচুর শুরু করে এবং শহরের ইহুদিদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। তারা মধ্য মিউনিখ দখল করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তাতে ব্যর্থ হয়।

আরও পড়ুন

নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের এই চেষ্টা পরদিন সকালেই শেষ হয়। মিউনিখের ওডিওন্সপ্ল্যাটজে (একটি বড় পাবলিক স্কয়ার) হিটলারের নেতৃত্বে আসা দুই হাজার সশস্ত্র নাৎসি মিলিশিয়া সেখানকার পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

অল্প কিছুক্ষণ দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলি চলে। এতে ঘটনাস্থলেই বাভারিয়ান পুলিশের চারজন সদস্য নিহত হন। পাল্টাপাল্টি গুলি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হিটলারের কাঁধে গুলি লাগে। তিনি পড়ে গেলে তাঁকে সেখান থেকে সমর্থকেরা টেনে নিয়ে যান। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক সহযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আড়াই দিন লুকিয়ে থাকার পর জার্মানির এই মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিকে (হিটলার) তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থক ও রাজনৈতিক সহচর হার্ভার্ড স্নাতক আর্নস্ট ‘পুতজি’ হানফস্টেঙ্গলের বাভারিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়ি থেকে আটক করা হয়। হিটলারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং ১৯২৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিচার শুরু হয়।

সরকারি কৌঁসুলির হিটলারকে বিদ্রোহের ‘প্রাণভোমরা’ আখ্যায়িত করে তাঁর সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন। কিন্তু ১ এপ্রিল ‘এপ্রিল ফুল দিবসে’র পরিহাসের মতো দেওয়া রায়ে বিচারক হিটলারকে দোষী সাব্যস্ত করলেও বাভারিয়ার আইনে সর্বনিম্ন সাজা দেন। রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে দেওয়া সর্বনিম্ন সাজা হলো পাঁচ বছর ‘সম্মানজনক জেল’, যাতে ভালো আচরণ সাপেক্ষে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই মুক্তি পাওয়ার সুযোগ ছিল।

আদালতের আদেশের পর হিটলারকে আদালত ত্যাগের এবং আদালতের বাইরে ছবি তুলতে পোজ দেওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সরকারি কৌঁসুলিরা হিটলারের লঘুদণ্ডের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারেননি এবং তিনি ওই বছরের শেষের দিকে ছাড়া পেয়ে যান। হিটলার তাঁর আত্মজীবনী মাইন কাম্ফ লেখার জন্য এই সংক্ষিপ্ত জেলজীবনের সময়টুকু ব্যবহার করেছিলেন।

ভাইমার রিপাবলিক সমর্থক জার্মানরা হিটলারের এভাবে ছাড়া পেয়ে যাওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যে লোক তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে সাজা হিসেবে গালে একটি মৃদু থাপ্পড়ের মতো সাজা দেওয়া হলো, এতে তারা রুষ্ট হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

হিটলারকে এই লঘু সাজা দেওয়ার কারণে তাঁর পক্ষে জনগণকে দেখানোর সহজ হয়েছে যে সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ‘মরে গেছে এবং তাকে কবরস্থ করা হয়েছে’। জার্মানদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাথলিক সংবাদপত্র হিটলারের মুক্তি পাওয়াকে এভাবেই বর্ণনা করেছিল।

প্রভাবশালী উদারপন্থী নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, আদালত এই রায় দিয়ে জোর করে গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের চেষ্টাকারীদের প্রকারান্তরে আবার একই ধরনের অপচেষ্টা চালানোর সবুজসংকেত দিয়েছেন।

রায় ঘোষণার পর হিটলারের সহমর্মী জার্মানরা বিরোধী উদারপন্থীদের ঠেস দিয়ে বলা শুরু করেছিলেন, তারা যেন ‘অতি আবেগপ্রবণ’ না হয়ে পড়েন এবং ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে, অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো’। তাঁদের কাছে হিটলারের বিরুদ্ধে দেওয়া এই রায়টি ছিল ‘গুরুদণ্ড’।

রায় ঘোষণার পর হিটলারের অনুসারীরা এক মাস ধরে জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালালেন যে হিটলার পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের পক্ষপাতমূলক রায়ের শিকার হয়েছেন। তাঁরা হিটলারের কারাবরণকে একজন মহান দেশপ্রেমিকের মহান আত্মত্যাগ হিসেবে তুলে ধরা শুরু করলেন।

আরও পড়ুন

কিছু সংবাদমাধ্যম এই তালে তাল মেলাতে শুরু করল। মিউনিখের একটি মধ্য-দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্র ঘোষণা করল, অভিযুক্তের (হিটলারের) প্রতি তাদের সহমর্মিতা ‘গোপনীয় কিছু নয়’ এবং গণতন্ত্রপন্থী ভাইমার রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতাদের ওই পত্রিকাটি ‘নভেম্বর ক্রিমিনাল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। নাৎসি সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য হিটলার তার প্রতিপক্ষের লোকদের ‘নভেম্বর ক্রিমিনাল’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেই পত্রিকাটি হিটলারবিরোধীদের সমালোচনা করেছিল।

বিচারের সময়ও হিটলার একইভাবে আদালতে উপস্থিত দর্শকদের সামনে নিজেকে ‘অপরাধী সরকারের’ বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। আদালত কক্ষ হিটলারের সমর্থকের পূর্ণ ছিল। কৌতূহলী নারী, কিশোরসহ সব ধরনের মানুষে ঠাসা ছিল সেই কক্ষ। মামলাটি যখন একদম শেষ পর্যায়ে চলে আসে এবং বিচারক রায় দিয়ে দেন, তখন হিটলার বলেছিলেন, আদালতের এই রায়ে কিছুই আসে–যায় না, কারণ, ‘ইতিহাসের দেবী’ তাঁকে খালাস দেবেন।

ইতিহাসবিদেরা একমত, হিটলারের ১৯২৪ সালের ওই বিচারটি আসলে একটি প্রতারণামূলক বিচার ছিল। হিটলারের সেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে শেষ করে দেওয়ার বদলে উল্টো তাঁর জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল এবং এক দশকের কম সময়ের মধ্যে ভাইমার রিপাবলিক শাসনব্যবস্থাকে তিনি দুমড়েমুচড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ন্যায়বিচারের সেই গর্ভপাতের ঘটনাটি ঘটেছিল গণতন্ত্রবিরোধী অধ্যুষিত দক্ষিণের একটি আদালতে। সেই আদালতের প্রধান বিচারক জর্জ নিথার্ডের পক্ষপাতমূলক রায়ের কারণে হিটলার সেই ছাড় পেয়েছিলেন। হিটলারকে বড় সাজা থেকে অব্যাহতি দিতে পেরে রক্ষণশীল ভাবধারার বিচারক নিথার্ড আনন্দিত হয়েছিলেন।

হিটলারের ১৯২৪ সালের সেই বিচারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এখনকার ভাষ্যকারদের খুব একটা ঐকমত্য নেই। আমেরিকান রক্ষণশীলেরা যেভাবে ট্রাম্পবাদ ও ফ্যাসিবাদের তুলনা করাকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে উড়িয়ে দেন, একইভাবে কিছু ইতিহাসবিদ যুক্তি দিয়ে থাকেন, ভাইমার রিপাবলিকের পতন থেকে বর্তমান মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতার শিক্ষা নেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই।

তাঁদের কাছে হিটলারের ১৯২৩ সালের অভ্যুত্থানচেষ্টার সঙ্গে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ‘সেভ আমেরিকা’ র‍্যালি করার এবং সেই র‍্যালি থেকে ক্যাপিটল হিলে হামলা চালানোর (এ হামলায় পাঁচজন মানুষ নিহত হন এবং কমপক্ষে ১৪০ জন আহত হন) কোনো সাদৃশ্য নেই।এই দুটি ঘটনাকে সমান্তরালই আনতে শুধু যে রক্ষণশীলরাই উদাসীন, তা নয়। বেশির ভাগ আমেরিকান উদারপন্থীরাও ১৯২৪ সালের ঘটনাগুলোকে তলিয়ে দেখার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।

অথচ যদি তাঁরা ১৯২৪ সালের সেই ঘটনাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন, রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ঠিক এক শতাব্দী আগে হিটলারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার মতোই ট্রাম্প-সমর্থকদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই মামলাগুলো মূলত ট্রাম্পের সমর্থকদের আগের চেয়ে বেশি উৎসাহিত এবং উজ্জীবিত করেছে।

১৯২৪ সালের হিটলারের মতোই ট্রাম্প এখন আদালত কক্ষকে নিজেকে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপনের একটি মোক্ষম মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছেন। আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি সমানে বলে যাচ্ছেন, একটি কুটিল ‘পর্দার অন্তরালে থাকা শক্তি’ তাকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে।

হিটলার এবং ট্রাম্পের এই সাযুজ্যপূর্ণ ঘটনা গুরুত্বসহকারে তুলনা করে দেখলে ডেমোক্র্যাটরা বুঝতে পারবেন, রিপাবলিকানরা কোনো অবস্থায় আছেন, আর তারাই বা কোথায় আছেন।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • মার্ক জোনস ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক ও ১৯২৩: দ্য ফরগটেন ক্রাইসিস ইন দ্য ইয়ার অব হিটলার’স ক্যু (বেসিক বুকস , ২০২৩) বইয়ের লেখক।