সামান্য কটূক্তি বা মানহানির মামলায় অনেককে বিনা বিচারে মাসের পর মাস জেল খাটতে হলেও আগুনে পুড়ে ৫৪ জন শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় হাশেম ফুডস কারখানার মালিক আবুল হাশেম ও তাঁর ছেলেদের জামিন পেতে লেগেছিল মাত্র ১০ দিন।
রূপগঞ্জের হাশেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে শ্রমিক-কর্মকর্তাসহ ৫৪ জনের মৃত্যু হয় ২০২১ সালের ৮ জুলাই। ১০ জুলাই কারখানার মালিক ও তাঁর ছেলেদের গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁদের সবার জামিন হয়ে যায় ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে। বিচার ছাড়া কাউকে জেলে আটক রাখা অনুচিত, কিন্তু মামলা প্রভাবিত করার মতো কারও যখন দ্রুত জামিন হয়ে যায়, তখন ন্যায়বিচার ঝুঁকির মুখে পড়ে।
হাশেম ও তাঁর ছেলে দ্রুত জামিন পাওয়ায় অনেকেই ন্যায়বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের সেই আশঙ্কাই যেন সত্যি হলো, সম্প্রতি ঘটনার দুই বছর পর ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মালিকপক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
অবশ্য তদন্তে কারখানার মূল নকশা না মানা, শর্ত ভঙ্গ করে অন্য পণ্য উৎপাদন, অনুমতি ছাড়া কারখানা সম্প্রসারণ, অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রাখাসহ যেসব অনিয়ম পেয়েছে সিআইডি, সেসব অভিযোগে কারখানার চার কর্মকর্তা ও সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দুই পরিদর্শককে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাম আসাটা ইতিবাচক হলেও কারখানার এসব গুরুতর অনিয়ম ও অবহেলার জন্য মালিকপক্ষকে দায়ী না করাটা যেকোনো বিবেচনাতেই অগ্রহণযোগ্য।
কারখানার মালিকদের নাম বাদ দেওয়ার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, তদন্তকালে আবুল হাশেম ও তাঁর চার ছেলের বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চলুন যাচাই করে দেখা যাক, কারখানার ভবন নির্মাণ ও অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে মালিকপক্ষের জড়িত না থাকার ব্যাপারটি কতটা গ্রহণযোগ্য।
অভিযোগপত্রে কারখানার যেসব অনিয়ম ও অবহেলার কথা উঠে এসেছে, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, কারখানার মূল নকশায় তিনটি সিঁড়ি থাকলেও নির্মাণকালে দুটি সিঁড়ি রাখা, শুধু ম্যাঙ্গো জুস উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্র নিয়ে লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, মুড়ি, ক্যান্ডি, জ্যাম-জেলি, আচার, ম্যাঙ্গো বার, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি উৎপাদন, অনুমতি ছাড়া কারখানা সম্প্রসারণ, কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না রাখা, প্রতিটি ফ্লোরে নেট দিয়ে শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রাখা, চলাচলের সিঁড়ি তালাবদ্ধ করে রাখা, কারখানায় দাহ্য পদার্থের সঙ্গে উৎপাদিত মালামাল মজুত করে রাখা, শিশু আইন অমান্য করে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি।
এসব অনিয়ম ও অবহেলার কোনোটাই কারখানার মালিকপক্ষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন ছাড়া শুধু ব্যবস্থাপক পর্যায়ের ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটানো সম্ভব নয়। কারখানার ভবনের আকার-আকৃতি, নকশা, সম্প্রসারণ, অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে অর্থ বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সাধারণত কেবল কারখানার মালিকেরই থাকে। তা ছাড়া শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারেও শ্রমিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব মালিকের ওপরেই বর্তায়।
দেশে গত দুই দশকে বহু কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের কোনো ঘটনায় মালিকের শাস্তি হওয়ার নজিরও নেই। তবে এসব ঘটনায় বিচার নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা চললেও মামলার অভিযোগপত্র থেকে মালিকগোষ্ঠীকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেনি। হাশেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দুই বছর পার করে মালিকপক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের ঘটনাটি দেশে আইনের শাসনের আরেক ধাপ অবনমনের সাক্ষ্য বহন করে।
শ্রম বিধিমালায় যে ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিলে কারখানার মালিক প্রতিদিন অপরাধ করছেন বলে গণ্য করার কথা বলা আছে, সেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে হাশেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫৪ জনের মৃত্যুতে মালিকের কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে না পাওয়া বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার। অবশ্য মালিকপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে রানা প্লাজা ভবন ধস বা তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের মতো দুনিয়া তোলপাড় করা ঘটনাতেও এখন পর্যন্ত কারখানার মালিকদের কোনো শাস্তি হয়নি।
দেশে গত দুই দশকে বহু কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের কোনো ঘটনায় মালিকের শাস্তি হওয়ার নজিরও নেই। তবে এসব ঘটনায় বিচার নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা চললেও মামলার অভিযোগপত্র থেকে মালিকগোষ্ঠীকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেনি। হাশেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দুই বছর পার করে মালিকপক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের ঘটনাটি দেশে আইনের শাসনের আরেক ধাপ অবনমনের সাক্ষ্য বহন করে।
কারখানার মালিকের দায়িত্ব শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা আর সরকারের দায়িত্ব হলো, মালিকপক্ষ তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে কি না, সেটার তদারক করা। মালিকপক্ষ যদি নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করে এবং তদারকি সংস্থার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন, তাহলে সরকারের কাজ হলো, জরিমানা ও শাস্তির মাধ্যমে এমন একটি বার্তা দেওয়া, যেন মালিকপক্ষ ও তদারককারীদের কাছে নিরাপত্তায় অবহেলা ও দুর্নীতি লাভজনক মনে না হয়।
কিন্তু দেশে দিনের পর দিন নিয়মিত বিভিন্ন কারখানা ও ভবনে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে চললেও মালিকপক্ষ ও তদারককারীদের এ ধরনের কঠোর কোনো বার্তা দেওয়ার আগ্রহ সরকারের দিক থেকে দেখা যায় না।
আসলে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের দরিদ্র, শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, বরং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখলেই চলে, সে কারণে এসব অবহেলাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।
● কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক