অর্থনীতির লাইফলাইন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, কিন্তু এটা এমন শহর, যেখানে বর্ষাকালে অল্প কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তায় নৌকা চলে। চট্টগ্রামের চিরস্থায়ী জলাবদ্ধতাকে আমি চিহ্নিত করি তিনটি বিশেষণে—ক. ভুলের বিপরীতে পাল্টা ভুল; খ. দুর্নীতির বিপরীতে আরও বেপরোয়া দুর্নীতি এবং গ. জ্ঞান ও গবেষণার বিপরীতে ক্রমাগত অজ্ঞতা।
ভুল, দুর্নীতি এবং অজ্ঞতা থামানোর উপায় স্থানীয় সমাজকর্মীরা সবাই কমবেশি জানলেও জানেন না চট্টগ্রামের মেয়র, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি, পাউবো, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী, একনেক এবং সর্বোপরি সরকার।
ফলে সাত মাসে চট্টগ্রাম ১০ বার ডোবে। আগে যেখানে জলাবদ্ধতায় হাঁটু থেকে কোমরপানি হতো, এখন সেখানে বুকপানি হয়, যেখানে জোয়ারের কয়েক ঘণ্টা পরে পানি চলে যেত, সেখানে টানা কয়েকদিন জলাবদ্ধতার কবলে থাকে অসহায় অভিভাবকহীন চট্টগ্রামবাসী।
প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকায় চারটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান থাকার পরেও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি হয়েছে টানা দুই বছর।
সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমল থেকে এমন কোনো বছর নেই যখন চট্টগ্রামের ড্রেনেজ উন্নয়নে সিটির বাজেটের অনুপাতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করা হয়নি। বাস্তবে প্রতিবার কিছু রাস্তা উঁচু করে সমাধান খোঁজা হয়, ড্রেন পরিষ্কারের যন্ত্রপাতি কেনার আয়োজন হয়।
সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সব বাদ দিয়ে রাস্তা উঁচু করায় ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছিলেন। বর্তমানেও উন্নয়নের নামে অর্থের শ্রাদ্ধ চলছে কিন্তু জলাবদ্ধতা কমছে না; বরং ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। মেয়রের বাসভবন পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়।
২০২২ সালে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের কমিটির দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার জন্য পাঁচ কারণ চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো হলো, ক. অতিবর্ষণ ও একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার; খ. খালের সংস্কারকাজের চলমান অংশে মাটি থাকার কারণে খাল সংকোচন; গ. নগরের খাল ও নালা-নর্দমা বেদখল; ঘ. নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে খাল-নালায় বর্জ্য ফেলা এবং ঙ. নিয়মিত খাল-নালা থেকে মাটি উত্তোলন না করা।
গত এক বছরে মাত্র দুই পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনমতে সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেনি সিটি করপোরেশন। কারণ, চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমাধানে ৬টি স্বল্পমেয়াদি ও ১১টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছে কমিটি। নগরের ৩২টি খালে কী কী সমস্যা রয়েছে, তার পরিদর্শন প্রতিবেদন মেয়রকে দেওয়া হলেও সমাধানের কাজ এগোয়নি।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সব কারণ একসঙ্গে পেতে আমাদের দুই দশক পেছনে যেতে হয়। ইউএনডিপির সহায়তায় ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে করা হয়েছিল ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’।
পাঁচ পর্বে বাস্তবায়নের এই প্রকল্প পরিকল্পনার প্রথম ধাপটি জোড়াতালি দিয়ে শেষ করে মাস্টারপ্ল্যানকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে। ২০ বছর ধরে বাকি চার ধাপের বাস্তবায়নের কোনো রোডম্যাপ নেই।
ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণেতাদের একজন প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, যিনি চট্টগ্রামের সমাজকর্মী হাসান মারুফ রুমী এবং এই লেখকের সঙ্গে প্ল্যানটির বিস্তারিত খুঁটিনাটি আলোচনায় হতাশা প্রকাশ করে ২০১৯ সালের বর্ষায় বলেছিলেন, অনেকটা সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনিচ্ছার কারণে প্ল্যানটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মাস্টারপ্ল্যানের বাইরে গিয়ে মেয়র সাহেব আবাসিক এলাকা সম্প্রসারণ, ভবন ও রাস্তা নির্মাণে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং পরবর্তী সব মেয়র এই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
শুধু রাস্তা উঁচু করে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। জোয়ার আসে সাগরতল থেকে অন্তত ১৬ ফিট ওপরে, চট্টগ্রামের কিছু এলাকা মাত্র ৮-১০ ফুট ওপরে, বাকি ৮-১০ ফুটের ঘাটতির সঙ্গে বৃষ্টির ও নর্দমার পানির উচ্চতা মিলে, উঁচু রাস্তায়ও জলাবদ্ধতার প্রকৃত সমাধান আসে না। সিডিএ চেয়ারম্যান এবং মেয়রদের কেউ বিষয়টি কেউ বুঝতে চেষ্টা করেননি, ঢাকার সচিবালয় কিংবা মন্ত্রণালয়ও বোঝার চেষ্টা করেনি। রাজনৈতিক স্বার্থে জলাধার ও নর্দমার জায়গায় ভূমি বরাদ্দ ও ভবন নির্মাণ তাই থামেনি।
মাস্টারপ্ল্যানে অতিবর্ষণ ও একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর জোয়ারকে (পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ারসহ) আমলে নিতে স্লুইসগেটসহ গাইড ওয়াল, বিশালাকার জলাধার নির্মাণ, পাম্প আউট সক্ষমতা তৈরির সুনির্দিষ্ট ‘টাইডাল রেগুলেশন’ এবং জোয়ারের সময় ড্রেন নিষ্কাশনে রিটেনশন সেন্টার ইত্যাদি অবকাঠামোর উল্লেখ ছিল, যা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ক্রমাগত নগর সম্প্রসারণ না করে, কিছু এলাকাকে বন্যার পানিপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, জোয়ারের সময়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি (বৃষ্টিতে গড়িয়ে পড়া আরবান রানঅফ এবং সুয়ারেজ/নর্দমার মিলিত প্রবাহ) যেখানে সাময়িকভাবে সঞ্চিত করা যাবে। কিন্তু এই বুদ্ধিবৃত্তিক পরিকল্পনা ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
যেহেতু নগরায়ণ শহরের নিচু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, উল্টো জলাধার না করেই শহরের কভার্ড এরিয়া ব্যাপক বাড়িয়ে আরবান রানঅফ বা মোট গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির পরিমাণ বেড়েছে এবং জোয়ারের সময় নর্দমার পানির সঙ্গে মিলে সার্বিক জলাবদ্ধতা পরিস্থিতিকে নাজুক করে।
শুধু রাস্তা উঁচু করে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। জোয়ার আসে সাগরতল থেকে অন্তত ১৬ ফিট ওপরে, চট্টগ্রামের কিছু এলাকা মাত্র ৮-১০ ফুট ওপরে, বাকি ৮-১০ ফুটের ঘাটতির সঙ্গে বৃষ্টির ও নর্দমার পানির উচ্চতা মিলে, উঁচু রাস্তায়ও জলাবদ্ধতার প্রকৃত সমাধান আসে না। সিডিএ চেয়ারম্যান এবং মেয়রদের কেউ বিষয়টি কেউ বুঝতে চেষ্টা করেননি, ঢাকার সচিবালয় কিংবা মন্ত্রণালয়ও বোঝার চেষ্টা করেনি। রাজনৈতিক স্বার্থে জলাধার ও নর্দমার জায়গায় ভূমি বরাদ্দ ও ভবন নির্মাণ তাই থামেনি।
নিজেদের লোকদের দখল স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বলে বরাদ্দ থাকলেও জলাধার ও গাইড ওয়াল নির্মাণে কর্ণফুলী ভূমি অধিগ্রহণ আটকে থাকে। বড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প পাস হলেও চার-পাঁচ বছরেও কাজ এগোয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্ণফুলী নদীর তীরে দেয়াল নির্মাণ, ২৫টি খাল ড্রেজিং এবং খালের মুখে পাম্পহাউসসহ স্লুইচগেট নির্মাণের জন্য হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও এগোয় না।
উল্টো ২০১৫ সালের চট্টগ্রামে নতুন এক দুঃখ যুক্ত হয়েছে। জোয়ারের পানি থেকে বাঁচতে নগর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মহেশখালে স্থায়ী স্লুইসগেট নির্মাণ না করে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে, পরের বছরই এটি নগরীর বিশাল একটি এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাগরপারে অবস্থিত নদী ও খাল বেষ্টিত একটি নগরে টানা জলাবদ্ধতা আসলে নগর-পরিকল্পনার নির্বুদ্ধিতা এবং প্রশাসনের হীন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকেই নির্দেশ করে যায়।
টিলা ও পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রাম অসমতল। স্বাভাবিকভাবে (মূলত পাহাড় কাটার কারণে বেশি) পাহাড়ের বালি বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে নর্দমা ভরে ফেলে। নিয়মিত বর্জ্য পরিষ্কার না করলেও নর্দমা সংকীর্ণ হয়ে যায়। মাস্টারপ্ল্যানে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টার্শিয়ারি ড্রেন বা নর্দমা এবং সেখানে মেইনটেন্যান্স পয়েন্ট বা পাহাড়ের পানির বালি আটকানোর ফিল্ড ট্র্যাপ বা মাড ট্র্যাপ ডিজাইন করা ছিল, যা বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেখানে ড্রেনের প্রস্থচ্ছেদ বা ক্রস সেকশন কম আছে, সেখানে মাড ট্র্যাপসংখ্যা বাড়ানোর কথা ছিল। বাস্তবে দেখা গেছে, দরকারি ড্রেন ব্লক করে ফ্লাইওভারের পিলার করা হয়েছে। এসব অজ্ঞতাকে লালন করা হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়নের নামে।
বৃষ্টির পানি, জনবসতি বাড়ার সঙ্গে দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানি ও সুয়ারেজের বর্ধিত পরিমাণ ফোরকাস্ট করে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক নির্দিষ্ট সময় পর পর রিডিজাইন ও রি-কনস্ট্রাক্ট করা চাই। এসব গ্রোথ ফোরকাস্ট না করে বর্ধিত জলাবদ্ধতাকে জলবায়ু পরিবর্তন নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। অসমতল ল্যান্ডস্কেপের শহরে ড্রেনের গভীরতাকে সমুদ্র সমতল ও জোয়ারের উচ্চতার সঙ্গে সমন্বিত করা হয়নি, ফলে ড্রেন থাকলেও উচ্চতার ভিন্নতায় পানি প্রবাহিত না হয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
চট্টগ্রামে ১৭ থেকে ২৫টি খালের প্রতিটি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেদখল হয়েছে, খালে ময়লা ডাম্পিং এত ব্যাপকভাবে করা হয় যে কয়েক বছর আগে চাক্তাই খালের ময়লার স্তূপের ওপরে বাচ্চাদের ফুটবল খেলার ছবি পত্রিকায় এসেছে।
চট্টগ্রাম বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এক নগরী, দৈনিক ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ (মানববর্জ্য) জমা হয় সেপটিক ট্যাংকে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ ঘনমিটার চসিকের এবং ২০ ঘনমিটার এনজিও ডিএসকের ব্যবস্থাপনায় পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি বর্জ্যের গন্তব্য নর্দমা, খাল, কর্ণফুলী।
চট্টগ্রামের ড্রেন-খাল অপদখলকে চিহ্নিত করা হয়েছে একাধিকবার, কোথাও পর্যাপ্ত খাল না থাকলে খনন করার কথাও বলা হয়েছে। প্রতিবছর বৃষ্টি ও জোয়ার ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়, কিন্তু বর্ষা চলে গেলে আলোচনা এবং বাস্তবায়নের কাজ—দুটিই থেমে যায়, বরাদ্দের অর্থও নয়ছয় হয়। এভাবেই চলছে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। সিনিয়র সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন জিজ্ঞো নেদারল্যান্ডস। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: [email protected]