এ বছর এমন একটি সময়ে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে, যখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এবারের বিশ্ব আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যে ‘আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়ার’ আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরা সবাই জানি, এ দেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ। সরকারি হিসাবমতে, এ দেশে পঞ্চাশের বেশি জাতিসত্তা রয়েছে। তবে অনেক গবেষক দাবি করেন, বাংলাদেশে সত্তরের বেশি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে।
যাহোক, জাতিগত সংখ্যার হিসাব এ মুহূর্তে মেলানো না গেলেও এ দেশে যে বাঙালি ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক জাতিসত্তা আছে, সেটা সর্বজনস্বীকৃত একটি সত্য। নিয়তির কী খেলা, জুলাই মাসজুড়ে আপামর বাংলার সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে লড়াই করল, তার সঙ্গে এ বছরের বিশ্ব আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যের মধ্যে যেন এক নিবিড় যোগসূত্র তৈরি হয়েছে!
এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চরম দুর্ভাগ্য যে সরকারের স্বৈরাচারিতার জাঁতাকলে পড়ে তারা নিজেদের পরিচিতিটুকুও নিজেরা নির্ধারণ করার অধিকার হারিয়ে ফেলছে প্রায়। ২০১০ সালে প্রণীত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ আইনটি প্রণয়ন করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির দিককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের কথা বলা হলেও নিজ নিজ জাতিসত্তার পরিচিতি ও ভাষার স্বীকৃতির কথা আইনে বলা হয়নি। দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়া হলেও এ দেশের বহু জাতিসত্তার ভাষা আজ বিপন্নের মধ্যে আছে। সেসব ভাষা ধুঁকে ধুঁকে অতলে হারিয়ে যাবে কোনো একদিন!
আমরা সবাই জানি, দেশের প্রচলিত কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবি নিয়ে জুলাই মাসের প্রথম দিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনের শুরুটা খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সাধারণ দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অর্থাৎ প্রচলিত কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে মেধার মূল্যায়নের ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে সমসুযোগ পাওয়ার দাবি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা-ই বলি না কেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ যুগপৎ আন্দোলন বাংলাদেশের প্রচলিত চলমান ব্যবস্থার ভিতকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে যে আওয়ামী লীগ সরকারকে গদি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩)–এর অনুচ্ছেদগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে, যাতে প্রজাতন্ত্রের যেকোনো কাজে তারা প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন।
কোটাব্যবস্থার অর্থ এই নয় যে কাউকে দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর বিষয় কিংবা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে তাদের জন্য কোটা বণ্টন রাখা। কোটা হলো সেই ব্যবস্থা, যারা দেশের অভ্যন্তরে জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নতার কারণে রাষ্ট্রের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও ভৌগোলিকভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসের কারণে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সমান সুযোগ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত রয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাই পিছিয়ে থাকা সেই জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারি চাকরি কিংবা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটাব্যবস্থা রাখা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
কোটাবিষয়ক সর্বশেষ সিদ্ধান্তে দেখা যায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জন্য মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যেটি খুবই নগণ্য, অন্যায্য ও অযৌক্তিক। কেননা পাহাড় ও সমতলে যেখানে ৫০টির বেশি জাতিসত্তা রয়েছে, সেখানে ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা তাদের সঙ্গে মশকরা করার শামিল।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরুটা যদিও কোটাব্যবস্থার সংস্কারকে সামনে রেখে আবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামেই এটি পরিচালিত হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে যেভাবে দুর্নীতি গেড়ে বসেছে, তার সংস্কারের বিষয়টিও জোরালোভাবে সামনে চলে এসেছিল।
দুর্নীতির শিকড় এ সমাজব্যবস্থায় চরম শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে দিয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের জন্য সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন কঠিন এক বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছিল। ফলে সমাজের অসম ব্যবস্থার বিরূপ প্রভাব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর এসে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
এ আন্দোলন সাধারণ মানুষের আকাক্ষার প্রতিফলনকেও তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে শেষের দিকে ঘরে থাকা মায়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। মায়েরাই সন্তানদের এ আন্দোলনে শামিল হতে সাহস জুগিয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য যে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকেই এ দেশের জাতিসত্তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকার করতে শুরু করে। যদিও ২০০৮–এর নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী কথাটি তারা স্পষ্ট উল্লেখ করেছিল। আওয়ামী লীগ এতটাই স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়েছিল যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর থেকে সরকারি আদেশ জারি করে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করা ও আদিবাসী দিবস পালন না করার নির্দেশ দেয়।
তাই বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে জারি করা পরিপত্রগুলো অচিরেই প্রত্যাহার করে নেয়, যাতে এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা তাদের নিজ নিজ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার ফিরে পায়।
আরেকটি বিষয় এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনের তরুণ নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কিন্তু বারবার বলেছেন, কোটাব্যবস্থায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা বহাল রেখে বাকি ক্যাটাগরির কোটায় সংস্কার করা হোক।
কিন্তু কোটাবিষয়ক সর্বশেষ সিদ্ধান্তে দেখা যায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জন্য মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যেটি খুবই নগণ্য, অন্যায্য ও অযৌক্তিক। কেননা পাহাড় ও সমতলে যেখানে ৫০টির বেশি জাতিসত্তা রয়েছে, সেখানে ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা তাদের সঙ্গে মশকরা করার শামিল।
সবশেষে বলব, কোটাবৈষম্য আন্দোলনের শহিদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ বিজয়ে যেন পাহাড়-সমতল সবখানে সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
কোটাবৈষম্য আন্দোলনের সব শহিদের প্রতি আদিবাসী দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক