বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও সিলিকন ভ্যালির অলিগার্ক তাঁর সেই সহযোগী অলিগার্কের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, যাঁর আঙুলের ডগা রাশিয়ার পারমাণবিক বোমার বোতামের ওপর ধরা আছে। এই দুই ‘মহান’ ব্যক্তি বিচারবুদ্ধিহীন বিশ্ব জনতার মূর্খামি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন এবং আমাদের মতো আমজনতার কথা না শুনে তাঁরা আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের নেওয়া পদক্ষেপের বদৌলতে ধরিত্রীঘাতী মহাযুদ্ধ থেকে আমরা রেহাই পেয়ে গেছি।
এটি ইলন মাস্কের জীবনীগ্রন্থ ইলন মাস্ক ও বইটির প্রচারণার সারকথা। এই কথাগুলো অবশ্য শতকোটিপতি ইলন মাস্ক বা তাঁর জীবনীকার সরাসরি বলেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (আগে যেটির নাম ছিল টুইটার)-এর সিইও ইলন মাস্ক গত শরতে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে তাঁর স্টারলিংক স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনসের সুবিধা আর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কার্যত বিশ্বকে পারমাণবিক বোমা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছিলেন বলে বইটিতে দাবি করা হয়েছে।
ইলন মাস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুতিন নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ইউক্রেনীয়রা যদি রাশিয়ার দখল করে নেওয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপে দখলদার রুশ বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, তাহলে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়া জানাবে। সেই কারণেই ইলন মাস্ক ক্রিমিয়ায় হামলা চালানোর বিষয়ে ইউক্রেনকে প্রযুক্তি সহায়তা দিতে রাজি হননি।
কিন্তু এটি ডাহা মিথ্যা। কারণ, ইতিমধ্যে ইউক্রেন ক্রিমিয়ায় কয়েক ডজন সামরিক হামলা চালিয়েছে এবং সেগুলোর কয়েকটি বেশ আলোড়ন তোলার মতো অভিযান ছিল। এটি লেখাটা খুব ভব্যতার পরিচায়ক হবে না, তথাপি লিখতে হচ্ছে: এসব অভিযান এখনো কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ ডেকে আনেনি। বরং এসব অভিযান পারমাণবিক বোমা ফাটানোর আশঙ্কাকে কমিয়ে দিয়েছে।
আমরা আমাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এ কথা কারোরই বলা উচিত হবে না যে ইউক্রেনের সীমানায় নোঙর করা রুশ যুদ্ধজাহাজে ইউক্রেনের হামলা ঠেকিয়ে দিয়ে ইলন মাস্ক প্রকারান্তরে পারমাণবিক যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দিয়েছেন। কারণ, গত কয়েক দিনে সেখানে থাকা রুশ জাহাজগুলোর ওপর ইউক্রেন বেশ কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া তার ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজগুলো দ্রুত সারিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়ার লোকেরা এখন জানে, তারা যুদ্ধরত অবস্থায় আছে এবং তাদের প্রতিপক্ষ ইউক্রেন যেকোনো সময় প্রত্যাঘাত করতে পারে।
১৯ মাস যুদ্ধের পর বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক বুঝতে পারছেন, রাশিয়া কয়েক দিন পরপর পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের যে হুমকি দিচ্ছিল, সেটি ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ। ইলন মাস্কের দাবিটি প্রকারান্তরে রুশ প্রচার-প্রোপাগান্ডাকেই ঘষামাজা করে নতুন রূপে আমাদের সামনে আনছে এবং এটি রাশিয়ার জন্য নতুন শ্রোতা খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। এটি আসলে রাশিয়ার মিথ্যাচারের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে ইলন মাস্কের কাজকারবার পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমানোর বদলে তা বরং বাড়িয়েছে।
পারমাণবিক যুদ্ধের কিছু ঝুঁকি বরাবরই ছিল, যেটি রাশিয়া বড় ধরনের হামলার মাধ্যমে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে রাশিয়ার পরমাণু ব্ল্যাকমেলকে ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত পাত্তা না দিয়ে সেই ঝুঁকিকে অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। যদি ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করত, তাহলে বাকি বিশ্বের কাছে এই বার্তা যেত: হয় ব্ল্যাকমেল করতে, নয়তো ব্ল্যাকমেলের হাত থেকে বাঁচতে তোমার কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকতেই হবে।
ইউক্রেন শত চাপের মধ্যেও রুখে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার সেই পারমাণবিক হুমকিকে চুপসে দিতে পেরেছে। আর সেই ধরনের কোনো বিপদের মধ্যে না থেকেই ইলন মাস্ক সেই পরমাণু ব্ল্যাকমেলে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, ইলন মাস্কের সেই কাপুরুষোচিত কাজটিকেই এখন মহিমান্বিত কাজ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
● টিমোথি স্নিডার ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষক