দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ২০১০ সাল ছিল নজিরবিহীন উত্থান ও পতনের বছর। বাজারে সে সময় অপ্রতিরোধ্য ঊর্ধ্বগতি শুরু হলো। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের বাঁশির সুরে বিনিয়োগ সাক্ষরতাবিহীন হাজার হাজার মানুষ এই বাজারে প্রবেশ করেছিলেন। তখন রাত পোহালেই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ত। দৈনন্দিন জীবনের সব বিষয় ছাপিয়ে উঠত দুটি শব্দ—‘মারি দেন’, মানে শেয়ার বেচে দিন। আরেকটি হচ্ছে, ‘আইটেম কী?’ আইটেম মানে সেই কোম্পানি, যেটির শেয়ারদর রাত পোহালেই বাড়বে। সর্বত্র তখন আইটেমদাতার ভীষণ কদর।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের অংশগ্রহণে বাজারের সূচক অযৌক্তিকভাবে বিপৎসীমা অতিক্রম করল। তখন স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা একদিন পূর্বাণী হোটেলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বললেন, ‘আপনারা আর শেয়ার কিনবেন না।’
তারপরের কথা সবার জানা। বাজার খুললেই সূচক পতনের বানে হাজার হাজার মানুষের আহাজারি শোনা যেত। ‘রাত পোহালেই লাভ’ এমন ধারণায় যাঁরা দলে দলে বাজারে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের হিসাবে অভাবনীয় গরমিল হলো। অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। যাঁরা ভুঁইফোড় কোম্পানির প্রাইমারি শেয়ার প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কিনেছিলেন, তাঁরা কাউকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। সইতেও পারছিলেন না।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারের উত্থান-পতনের নেপথ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পীর, মুরিদ, পুলিশ, উকিল, বিচারক, অনুঘটকসহ কার কী কী ছিল, তা বলতে গেলে হাজার পৃষ্ঠার দরকার হবে। তাই বাজারের মূল সংকটে আলোকপাত করা যাক। ১৯৫৬ সালে যে বাজারের ভিত্তি রচিত হয়েছিল, সেটি স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কেবলই শেয়ারবাজার থেকে গেছে। সরকারের কাছেও এই বাজারটি সূচকনির্ভর শেয়ারবাজার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে আলোচনা হয় শেয়ারদরের ওঠানামা নিয়ে। তাই সূচকের উত্থানে সাধারণ বিনিয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের স্বস্তি। আর পতনে সরকারসহ তদারকি সংস্থার অস্বস্তি।
আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই শেয়ারবাজারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেনি। সরকারকে যদি বলা হয়, পুঁজিবাজার দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতুসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব, তখন সরকারের কিছু লোক হয়তো অবাক হয়ে তাকাবেন। সব উন্নত দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাজার দিয়েই সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর হয়েছে। আর আমাদের এখানে কোম্পানি পুঁজিবাজারে না গিয়ে ব্যাংকে যাবে। ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করবে। যার ফল লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
ব্যাংক খাতে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণ হচ্ছে উপেক্ষিত পুঁজিবাজার। স্টক এক্সচেঞ্জে সরকারি-বেসরকারি কোম্পানির তালিকাভুক্তির মাধ্যমে তথ্য প্রকাশে বাধ্যবাধকতার কারণে কোম্পানিতে একটা সুশাসন নিশ্চিত হয়। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে। উদ্যোক্তার অবর্তমানে অতালিকাভুক্ত একটি ভালো কোম্পানিও মরে যেতে পারে। কিন্তু কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তার মারা যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
নীতিসহায়তা প্রদানে সরকারের উদাসীনতা, কোম্পানির উদ্যোক্তাদের পরিবারকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে ভালো কোম্পানির অভাবে এখানে পুঁজিবাজার গড়ে ওঠেনি। বহুজাতিক কোম্পানি অন্য দেশে ব্যবসা করলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লাভ ভাগাভাগি করে নেয়। আর এ দেশে ব্যবসারত সেসব কোম্পানিকে দেনদরবার বা নীতিসহায়তার বাজারে আনতে সরকারের তরফ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
বাজারে সিংহভাগ দুর্বল কোম্পানির ভিড়ে কিছু ভালো কোম্পানির গুরুত্বও অনেক সময় দৃশ্যমান হয় না। দুর্বল শেয়ারে খেলাধুলা চলে দেদার, লোভের বশবর্তী হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্বল মৌল ভিত্তির বাজারে পতন ঠেকাতে কৃত্রিম বাঁধ ‘ফ্লোর প্রাইস’ বসাতে হয়। আর এতে আমজনতাসহ বাজারসংশ্লিষ্টরাও শুরুতে খুশি হন আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পালিয়ে যান। বাজার পড়ে গেলে খেলোয়াড়দের সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
যাঁরা শেয়ারবাজার কম বোঝেন বা ঝুঁকি নিতে ভয় পান, তাঁদের মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার প্রবণতা আছে। কিন্তু কিছু ফান্ড ম্যানেজারের দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগের এ ক্ষেত্রটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত। তাঁরা বিনিয়োগকারীদের আমানত খেয়ানত করে মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে টিকে যান। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ফান্ড ম্যানেজারদের নৈতিকতা ও পেশাদারত্বের কারণে তাঁদের অধীনে পরিচালিত মোট সম্পদের পরিমাণ বাংলাদেশের জিডিপির আকারের চেয়ে বড়। তাঁরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সুরক্ষা ও লাভ নিশ্চিতের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করছেন। ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলা দেখার সময় টিভিতে সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের যে বিজ্ঞাপনটি দেখতে পায়, সেটি হলো, ‘মিউচ্যুয়াল ফান্ড সেহি হ্যায়’। এ বাজারে স্টক ব্রোকারদের মানসিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের অনেকে বিনিয়োগকারীর অর্থকে নিজের অর্থ মনে করেন। ডিমিউচ্যুয়ালাইজড স্টক এক্সচেঞ্জের একজন ট্রেকহোল্ডারের যে স্ট্যাটাস হওয়া উচিত, সেটা কতজনের আছে বা অর্জনের চেষ্টা করেন, তা বলা মুশকিল।
২০১০-এর মহাধসের এক যুগ পরও অনেকের বিনিয়োগের পত্রকোষ ঋণাত্মক রয়ে গেছে। অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে বিতরণ করা মার্জিন ঋণের পরিমাণের চেয়ে বিনিয়োগকারীদের সম্পদ বা শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীরা এখনো আটকে আছেন। তখনকার সুলভ ঋণের প্রভাব এ বাজার এখনো বইছে। বর্তমান বাজারে তারল্যপ্রবাহ স্বাভাবিক না হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি বড় কারণ। বাজারে সুশাসন ও ভালো কোম্পানির শেয়ারের জোগান নিশ্চিতের পাশাপাশি এ সমস্যাটিরও দ্রুত সমাধান জরুরি।
একটি ঘটনা দিয়ে দিয়ে এ লেখার ইতি টানা যাক। বাজারে লাউ কিনতে গিয়ে সবাই চিমটি কেটে কচি লাউ বাছাই করেন। শান্তিনগর কাঁচাবাজারে শেয়ারবাজারের এক বিনিয়োগকারী ৫০ টাকার এক লাউ কিনতে বিক্রেতার সব কটি লাউয়ে চিমটি কাটলে বিক্রেতা ক্ষিপ্ত হন। তখন বিনিয়োগকারীও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বললেন, ‘টেকা দিয়া জিনিস কিনুম আর দ্যাইখা কিনুম না?’ সেই বিনিয়োগকারী ৫০ টাকার লাউ কিনতে যে সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন, ৫০ লাখ টাকার শেয়ার কিনতে তা করেননি।
শেষ কথা হচ্ছে, শক্তিশালী পুঁজিবাজার ও সুশাসন ছাড়া একটি ভালো শেয়ারবাজার পাওয়া সম্ভব নয়।
মুহম্মদ মোফাজ্জল সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক