রাষ্ট্রের কাছ থেকে এখন আর আমরা তেমন কিছু আশা করি না। কারণ, এই রাষ্ট্র আপনাকে-আমাকে নিরাপদভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে, তেমন লক্ষণ আমরা দেখি না।
নাগরিকের বেঘোরে মরার এত আয়োজন চারদিকে তৈরি করে রাখা হয়েছে, সেখানে স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া কঠিন। লাশ পাওয়া তো আরও কঠিন। তাই পরিবারের সদস্যদের বলি একে অন্যের শনাক্তকরণ চিহ্ন ভালো করে জেনে নিই। অন্তত স্বজনের লাশটা বুঝে নিতে কিংবা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করতে আমার-আপনার অপেক্ষার দৈর্ঘ্যটা কমবে।
কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা? এক জোড়া গোলাপি মোজা পরা শিশুর লাশ পড়ে আছে মর্গে, মাথার ঝুঁটি অক্ষত। পরনে ধূসর রঙের হাফ হাতা গেঞ্জি আর নীল পায়জামা। কার বুকের ধন, কোথায় পড়ে আছে!
মিনহাজের কথা ভাবুন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পুলিশ যে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে, তার মেঝেতে ওর মা আমিনা খান পড়ে আছেন, বড় ছেলটা কোনোরকমে ধরে আছে মাকে। মিনহাজের কলেজজীবনের তিন বন্ধু জানান, মরদেহ মিনহাজের। ওর পেটে একটা অস্ত্রোপচার হয়েছিল, দাগ মিলিয়ে যায়নি। হাতঘড়িটাও ওর স্বজনেরা চিনতে পেরেছেন।
যদিও আরও একটি পরিবার এই মরদেহ তাদের স্বজনের বলে দাবি করেছে। আহা রে মায়া! সন্তানের প্রাণপাখি উড়ে গেছে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে সে। তাকে আর কখনো মা বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। কিংবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লামিসার কথা? তাঁর বাবা পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নাসিরুল ইসলাম তো নির্বাক হয়ে গেছেন। কিংবা অন্য যে ৪৩ জন আগুনের দমকে নেই হয়ে গেলেন তাঁদের স্বজনেরা? এই হাহাকার কি কোনো দিন রাষ্ট্রের বুকে বাজবে?
আপনি যদি বাংলাদেশে অগ্নিদুর্ঘটনার ইতিহাস দেখেন, তাহলে দেখবেন নাগরিকের বুকের যে ক্ষত তা থেকে আমৃত্যু ক্ষরণ হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের কিচ্ছু যায় আসেনি। যদি কিছু হতোই তাহলে একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা কি ঘটত?
বেইলি রোডের যে ভবন আগুনে শেষ হলো, সেই ভবন কর্তৃপক্ষকে এর আগেও তিনবার চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। শুক্রবার সকালে মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, এই ভবনে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল।
গত সেপ্টেম্বরে ভবন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া চিঠির একটি অনুলিপিতে দেখা যাচ্ছে, ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর অধীর চন্দ্র হাওলাদার অ্যাম্ব্রয়সিয়া রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মিউজিক ক্যাফেকে বলেছেন, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থায়ী ও অস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্তত দুটি বাধাবিহীন সিঁড়ি থাকতে হবে। অন্যথায়...।
আপনি কি মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের এই চেষ্টার কোনো মূল্য দেয় রাষ্ট্র? দেয় না, পদক দিয়েই খালাস। তারা ২০২৩ সালে ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা বিপণিবিতানের তালিকাও প্রকাশ করেছিল। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনাতে বসে তাদের ভালো হয়ে যাওয়ার অনুরোধও করে। কিন্তু তারা তো ভালো হয়নি, বা হয় না। কেন হয় না, তার পেছনে কারণ আছে।
তো অন্যথায় কী হলো? অধীর চন্দ্র হাওলাদার বলেন, তাদের তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ের মধ্যে তারা ব্যবস্থা নেয়নি। আপনারা কী করলেন? জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ভবনটিকে ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা দিয়ে সিল করার ক্ষমতা নেই।
আপনি কি মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের এই চেষ্টার কোনো মূল্য দেয় রাষ্ট্র? দেয় না, পদক দিয়েই খালাস। তারা ২০২৩ সালে ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা বিপণিবিতানের তালিকাও প্রকাশ করেছিল। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনাতে বসে তাদের ভালো হয়ে যাওয়ার অনুরোধও করে। কিন্তু তারা তো ভালো হয়নি, বা হয় না। কেন হয় না, তার পেছনে কারণ আছে।
আপনাদের নিশ্চয়ই ২০২২ সালে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কথা মনে আছে। ওই দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনসহ মারা যান ৫১ জন। বিএম কনটেইনার ডিপোটিও অগ্নিকাণ্ডের আগে পরিদর্শন করেছিল দুটি তদন্ত দল।
সেসময় বিবিসি বাংলাকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মোল্লা সিকান্দার আলী বলেছিলেন, কনটেইনারের ভেতর কী ধরনের দ্রব্য আছে, তা খুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুমতি তাঁদের ছিল না। তাঁদের শুধু জানানো হয়েছিল, কনটেইনারের ভেতরে গার্মেন্টস গুডস আছে। এমনকি আগুন লাগার পরেও ডিপোর ভেতর কী কী রাসায়নিক দ্রব্য আছে, সেই তথ্য জানানো হয়নি। ফলে ফায়ার ফাইটাররা আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণে পুড়ে মারা যান।
দুর্ঘটনার পর ছয়টি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রতিটি কমিটিই অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করে। সেই বিএম ডিপোর অন্যতম মালিক মুজিবুর রহমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন কী হবে, আমি-আপনি সবাই জানি। তদন্ত কমিটি হবে, গলার রগ ফুলিয়ে মন্ত্রী–মিনিস্টাররা বলবেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, কেউ কেউ বলবেন নির্দেশিত হয়েছেন রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতে এবং মামলা হবে। মানুষজন হইচই করলে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে, ইনফ্লুয়েন্সাররা ভিডিও বানালে ভবনমালিক বা মালিকেরা গ্রেপ্তার হবেন। যদি গ্রেপ্তার হন, তাহলে র্যাব-পুলিশ দুই পক্ষই ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করবে। আবার গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই জামিনও হতে পারে।
এই সম্ভাবনাগুলো উসকে দিতে পারলাম অতীতের বেশ কিছু অগ্নিদুর্ঘটনা/ভবন ধস কাভার করার সুবাদে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। ভবন ধসের পর সবার চোখের সামনে দিয়েই সোহেল রানা বেরিয়ে যান। পাঁচ দিন পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় নানান কায়দা করে র্যাব গ্রেপ্তার করে।
এর ঠিক এক বছর আগে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।। মামলার সুরাহা হয়নি ১০ বছরেও। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন ঠিকই ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। শুধু তাই না, মামলা সুরাহা না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লেগে ৭১ জন নিহত হন। ওয়াহেদ ম্যানশন লাগোয়া রাজমহল হোটেলের মালিক মো. আজম বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। তাঁর দেওয়া ফুটেজেই শনাক্ত হয় যে ওয়াহেদ ম্যানশন থেকেই আগুনের সূত্রপাত। তাঁরা ওখানে অবৈধভাবে পারফিউমের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছিলেন।
ওই ঘটনায় ভবন মালিক হাসান ও সোহেল আগেভাগেই জামিন নিয়ে নেন। তারা মামলার বাদী মো. আজমের ওপর চড়াও হন, তিনি তখন থানায় জিডিও করেছিলেন। সেই ওয়াহেদ ম্যানশন আবার চুনকালি করে চালু হয়েছে, যদিও ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা হয়েছিল। মামলা এখন মামলার মতো ঢিমেতালে চলছে। নিহত ৭১ জনের স্বজনেরা কি বেঁচে থাকতে আদৌ বিচার পাবেন? ফলে আমার আপনার মতো হতভাগা মানুষের স্বজনের শনাক্তকরণ চিহ্ন জেনে নেওয়া ছাড়া আর কী–ই বা করার আছে?
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]