সকল বিনম্র ইসরায়েলীর উচিত নিজেদেরকে কয়েকটি প্রশ্ন করা। সেগুলো হলো: তাদের দেশ গাজায় যুদ্ধ অপরাধ করছে কি না? যদি তাই হয়ে, তাহলে কিভাবে এটা বন্ধ করতে হবে? আর কিভাবে অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত? কে তাদের শাস্তি দিতে পারে? অপরাধ বিচারহীনভাবে চলতে থাকা আর অপরাধীরা পার পেতে থাকা কি যুক্তিসঙ্গত?
যে কোনো ইসরায়েলী অবশ্যই প্রথম প্রশ্নের উত্তরে’ না’ বলতে পারেন–দাবি করতে পারেন যে গাজায় ইসরায়েল কোনো যুদ্ধাপরাধ করছে না। সেক্ষেত্রে বাকী প্রশ্নগুলো তার জন্য অর্থহীন।
কিন্তু কিভাবে একজন প্রথম প্রশ্নটির নেতিবাচক জবাব দিতে পারেন যখন তাঁর সামনে গাজার যাবতীয় পরিস্থিতি ও তথ্যাদি রয়েছে: প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে আর ১০ হাজার নিখোঁজ। তাদের দুই-তৃতীয়াংশই নিরীহ বেসামরিক ও সাধারণ মানুষ যা খোদ ইসরায়েলী প্রতিরক্ষা বাহিনীই (আইডিএফ) বলছে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার শিশু, ৪০০ চিকিৎসা কর্মী আর ২০০ জনের বেশি সাংবাদিক। গাজার ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ওখানকার ৩০ শতাংশ শিশু চরম পুষ্টিহীনতায় ধুকছে; আর প্রতি ১০ হাজারে দু’জন মারা যাচ্ছে অনাহার ও অসুখে। এগুলো সব জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান।
এটা কি সম্ভব যে এরকম সব ভয়াবহ সংখ্যা কোনো রকম যুদ্ধ অপরাধ ঘটানো ছাড়াই তৈরি হয়েছে? ন্যায্য বা যৌক্তিক কারণে অনেক যুদ্ধ হয়ে থাকে যেখানে অপরাধের আশ্রয় নেয়া হয়। তবে যুদ্ধের ন্যায্যতা এর অপরাধকে ন্যায্যতা দান করে না।
[গাজায়] যে বিপুল পরিমাণে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, মানুষকে অনাহার ও বাস্তুচ্যুতির দিকে যেভাবে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তা ক্রমাগত যুদ্ধ অপরাধ ঘটানো ছাড়া হতে পারত না। এর জন্য কয়েকজন ব্যক্তি দায়ী এবং তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ইসরায়েলি হাসবারা বা গণ কূটনীতিক তৎপরতায় কিন্তু গাজার বাস্তবতা অস্বীকারে চেষ্টা করেনি। বরং এতে সারা দুনিয়ার কাছে পাল্টা এরকম প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে কেন শুধু আমাদের দিকেই আঙুল তোলা হচ্ছে? সুদান ও ইয়েমেনে যা ঘটছে সেদিকে নয় কেন? এসব প্রশ্ন তুলে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে ইহুদি-বিদ্বেষ (অ্যান্টি-সেমেটিজম) থেকে এমনটা করা হচ্ছে। এই যুক্তি ধোপে টিকে না।
মাত্রাছাড়া গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য চালককে থামালে সে এই বলে পার পায় না যে সে একা এমনটি করেনি। অথচ ইসরায়েলে অপরাধ ও অপরাধী– দুইই দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকছে। এসব অপরাধের জন্য ইসরায়েল কখনো কারো বিচার করবে না। যুদ্ধের অপরাধই হোক আর দখলদারির অপরাধই হোক, ইসরায়েল কখনোই তা করেনি। তবে কোনো এক সুদিনে ফিলিস্তিনীদের ক্রেডিট কার্ড চুরি করার জন্য হয়তো কোনো সৈন্যকে বিচারের মুখোমুখি করবে!
কাউকে না কাউকেতো এই বিচারের জন্য উঠে দাঁড়াতে হবে। অনেক ইসরায়েলি যেমন এটা চায় যে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শাস্তি হোক, তাদেরতো এটাও চাওয়া উচিত যে নেতানিয়াহু ও তাঁর সকল অধীনস্থরা আরো অনেক বড় ও মারাত্মক অপরাধের জন্য, গাজায় অপরাধ কর্ম ঘটানোর জন্য, শাস্তি পাক।
কিন্তু ন্যায় বিচারের জন্য মানবতার বোধ এটা দেখতে চায় যে অপরাধীরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে কোনো অপরাধে লিপ্ত হতে তাদেরকে বাধা দেয়া হয়েছে। এই যুক্তিতে হয়তো আমরা আশা করতে পারি যে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তার কাজটি করবে।
সকল দেশপ্রেমিক ইসরায়েলি এবং দেশের যারা ভাল চায়, তাদের প্রত্যেকেরই এরকমটি প্রত্যাশা করা উচিত। এটাই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে ইসরায়েলের নৈতিক মানদণ্ডের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এখন পর্যন্ত তো যে কোনো কিছু করাই এই মানদণ্ড হয়ে রয়েছে। নিজ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের এবং সেনাবাহিনীর গ্রেপ্তার হওয়ার প্রত্যাশা করা খুব সহজ নয়। তারচেয়ে কঠিন হল প্রকাশ্যে অপরাধ স্বীকার করা। কিন্তু তাদের থামানোর আর কোনো উপায় আছে কি?
গাজার হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা ইসরায়েলকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে যা সামাল দেয়া বেশ দুরূহ। দেশটি কখনো এরকম জঘন্যতম বিপরযয়ের মুখে পড়েনি। আর কেউ না কেউ তো এর নেতৃত্ব দিয়েছে। না। কোনো ইহুদি-বিদ্বেষ নয়। বরং দেশটির নেতারা ও সামরিক কর্মকর্তারাই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তাদের কারণেই ৭ অক্টোবরের পর খুব দ্রুত এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। তারাই সযত্নে লালিত একটি দেশের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে একে সারা দুনিয়ার কাছে অচ্ছুত রাষ্ট্রে রূপান্তর ঘটিয়েছে।
কাউকে না কাউকেতো এই বিচারের জন্য উঠে দাঁড়াতে হবে। অনেক ইসরায়েলি যেমন এটা চায় যে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শাস্তি হোক, তাদেরতো এটাও চাওয়া উচিত যে নেতানিয়াহু ও তাঁর সকল অধীনস্থরা আরো অনেক বড় ও মারাত্মক অপরাধের জন্য, গাজায় অপরাধ কর্ম ঘটানোর জন্য, শাস্তি পাক।
নেতানিয়াহু ও তাঁর দলবলকে বিনা শাস্তিতে পার পেতে দেয়া যাবে না। আলোচ্য অপরাধের জন্য হামাসের দায় থাকলেও শুধু তাদেরকে দায়ী করা যায় না। কারণ, আমরাই তো তারা যারা গাজাবাসীকে হত্যা করেছি, অনাহারে রেখেছি, ঘর ছাড়া করেছি এবং নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছি। কাজেই তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর নাটের গুরুতো অবশ্যই নেতানিয়াহু। হেগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনা প্রধানসহ তাঁর বন্দিদশার ছবি দেখাটা প্রত্যেক ইসরায়েলীর জন্য দু: স্বপ্নের মতো হলেও সম্ভবত এটাই হবে সঠিক।
হ্যাঁ, এমনটা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। আন্তর্জাতিক আদালতের ওপর ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ তৈরি করছে, তা প্রচণ্ড (এবং ভুল)। তবে ভীতির কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
যদি আগামী কয়েক বছর ইসরায়েলী কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়, যদি তারা কী হতে পারে ভেবে ভীত থাকে, তাহলে আমরা এটা নিশ্চিত হতে পারি যে আগামীবার কোনো যুদ্ধের সময় কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সেনাবাহিনী পাঠানোর আগে তাঁরা দু’দবার করে ভাববে। আমরা তা থেকে অন্তত একটু সান্ত্বনা পাবো।
গিডিয়ন লেভি একজন ইসরায়েলী সাংবাদিক। হারেৎজে প্রকাশিত তাঁর লেখাটির ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া