২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

লেবাননে ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ সহজে থামবে না

ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে লেবাননের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেনছবি: এএফপি

গত সপ্তাহে ইসরায়েল লেবাননে নির্বিচার কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। তারা যোগাযোগব্যবস্থার ডিভাইসে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বৈরুতের উপকণ্ঠের দাহিয়েহ্ এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে। এসব হামলাকে হিজবুল্লাহর ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

বহুসংখ্যক বেসামরিক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি এসব হামলায় হিজবুল্লাহর এলিট বাহিনী রাদওয়ান ইউনিটের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডাররাসহ সংগঠনটির কয়েক ডজন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। 

গত সোমবার ইসরায়েল তাদের হামলার তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে। এর অংশ হিসেবে তারা দক্ষিণ লেবানন এবং বেক্কা উপত্যকায় কয়েক দফা হামলা চালিয়ে এক হাজারের বেশি বেসামরিক লোক মেরে ফেলেছে। হিজবুল্লাহর যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ইসরায়েলের ঢুকে পড়া এবং সংগঠনটির ওপরের সারির নেতাদের হত্যা করার ঘটনা হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। 

গত মে মাসে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলের হামলার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের মধ্যে তথ্যসূত্রের অনিশ্চয়তা গুজব ও জল্পনা-কল্পনার আগুনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 

ইসরায়েলের এই হামলার জবাব দিতে হিজবুল্লাহ ব্যর্থ হলেও সপ্তাহান্তে হিজবুল্লাহ যে তাৎক্ষণিক সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা লেবাননের সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছে এবং তারা একে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে গ্রহণ করেছে। 

ইসরায়েলের রক্তাক্ত হামলা হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি জনসাধারণের সহানুভূতি বাড়িয়েছে এবং তাঁদের প্রতি পুরো দেশ সংহতি ও সমর্থন প্রকাশ করেছে। আহতদের রক্ত দেওয়ায় আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবীরা এগিয়ে এসেছেন। স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসকেরা উদ্ধারকাজ ও চিকিৎসায় যোগ দিয়েছেন। 

লেবাননের সরকারি লোকেরা এবং ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের নেতা ওয়ালিদ জাম্বল্যাটের প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক পার্টিসহ বেশ কিছু গ্রুপ আলাদাভাবে হামলার নিন্দা জানিয়ে সমাবেশ করেছে। 

হিজবুল্লাহর সঙ্গে এই গ্রুপগুলোর ঐতিহ্যগতভাবে দূরত্ব আছে। তবে তাদের এই অবস্থান প্রতীকীভাবে হলেও হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের এক ছাতার তলায় দাঁড় করিয়েছে। সামরিক ফ্রন্টে হিজবুল্লাহ ১০ হাজার স্বল্প ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে। সেগুলো ইসরায়েলের হাইফার দক্ষিণে বেশ কয়েকটি শহরে আঘাত হেনেছে। হিজবুল্লাহর নিশানার মধ্যে একটি ইলেকট্রনিক ম্যানুফ্যাকচারিং কমপ্লেক্স এবং একটি প্রধান ইসরায়েলি বিমানঘাঁটি রামাত ডেভিড অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির দুটি প্রাথমিক কৌশলগত লক্ষ্য হলো গাজা থেকে উত্তর ফ্রন্টকে বিচ্ছিন্ন করা এবং উত্তর ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হওয়া কয়েক হাজার ইহুদিকে আবার সেখানে ফিরিয়ে নেওয়া। তবে এ দুটি লক্ষ্য এখনই ইসরায়েল পূরণ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। 

গত সপ্তাহে হিজবুল্লাহর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল নাইম কাসিম ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ আরও ‘উন্মুক্ত মাত্রায়’ প্রবেশ করেছে এবং এর ফলে আরও অনেক লোক বাস্তুচ্যুত হতে পারে। 

হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি শহর ফাঁকা হয়ে গেছে এবং সেখানকার কয়েক হাজার বাসিন্দা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। এসব শহরের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোকে তাদের কাছে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের ভূগর্ভস্থ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায় কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়, কারণ তেল আবিব এসব স্থাপনার ক্ষতির খবর সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরার বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটি সত্য যে এই স্থাপনাগুলো হিজবুল্লাহর রকেটের পাল্লার সীমার মধ্যে রয়েছে এবং ইসরায়েলের বহুল পরিচিত আয়রন ডোম এসব রকেট সর্বাংশে ঠেকাতে সক্ষম নয়। 

হিজবুল্লাহর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সীমানা থেকে দূরে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারগুলোয় রাখা আছে। এ কারণে লিতানি নদীর দক্ষিণে লেবাননের ভূখণ্ডে ইসরায়েল স্থল আক্রমণ চালালে তা তাদের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ইসরায়েল এ ধরনের বেপরোয়া আক্রমণ করে বসলে তা হিজবুল্লাহ বাহিনীকেও বেপরোয়া করবে এবং উত্তরাঞ্চলীয় ইহুদি বসতিগুলোকে হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেট থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। 

ইসরায়েলের হামলার পর ফিলিস্তিন, ইয়েমেন ও ইরাকে থাকা হিজবুল্লাহর মিত্রদের মধ্যে সংহতি জোরদার করেছে। তারা ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়ে হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থনমূলক সামরিক পদক্ষেপের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এটি সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বর্তমান এই যুদ্ধকে কোনো বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ হিসেবে দেখা যাবে না। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এক জায়গার ক্ষতি বা লাভের সঙ্গে অপর জায়গার ক্ষতি বা লাভ সংযুক্ত। 

হিজবুল্লাহ বারবার বলে আসছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের উত্তরের বসতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ করা। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মে মাসে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, অবৈধ ইসরায়েলি দখলদারি ও ভূখণ্ড অবরোধের অবসান এবং বন্দীদের মধ্যস্থতামূলক বিনিময়ের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, হামাস তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল তাতে রাজি নয়।

উত্তর ফ্রন্টে আচমকা গোলাগুলির মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে এটি প্রকাশ করছে যে তারা একটি ন্যায্য ও যুক্তিসংগত সমাধানের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করায় আগ্রহী। এর জন্য তারা নির্লজ্জভাবে লেবাননে হামলা চালাচ্ছে এবং গাজা অবরোধ করে সেখানে মাসের পর মাস সন্ত্রাসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। জরুরি প্রশ্ন হলো, এ অঞ্চলে ইসরায়েলের অন্যায্য হামলা বন্ধে পশ্চিমারা কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা আর কতক্ষণ বসে থাকবে এবং চেয়ে চেয়ে সব দেখবে। 

হিচাম সাফিয়েদ্দিন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত