প্রথম আলো সময় ও সমাজের দায় কতটুকু পূরণ করতে পারল

একটি দৈনিকের প্রথম ও প্রধান কাজ সংবাদ পরিবেশন করা। প্রথম আলো সেই কাজ ২৬ বছর সময় ধরে করে যাচ্ছে। তবে একজন পাঠকের কাছে সব পত্রিকা সমান প্রহণযোগ্য হয় না। কারণ, খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার মধ্য দিয়ে পাঠক প্রকৃত তথ্যের ও সত্যের খোঁজ পেতে চান। প্রথম আলো খবর প্রকাশে এদিকটায় বিশেষভাবে খেয়াল রাখে। কোটি কোটি পাঠকের কাছে তাই প্রথম আলো নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, সংবাদ পরিবেশনের কারণে প্রথম আলো নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক, সেটি বোঝা যায়। মূলত বিভিন্ন সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করার কারণে প্রথম আলো আক্রোশের শিকার হয়েছে। পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

এর সাংবাদিক ও প্রতিনিধিদের ওপর হামলা হয়েছে। বিভিন্ন আমলে সরকারি বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এত কিছুর পরও প্রথম আলো সাহসী ও অবিচল থেকেছে। পক্ষপাতহীন সংবাদ পরিবেশন করেছে।

আমাদের অবাক লাগে, যখন শুনি স্বাধীনতার পর কোনো সরকারের আমলেই সাংবাদিকতা বাধাহীন ও স্বাধীন ছিল না। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে এই পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করেছেন কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, তাঁরাও হুমকি পেয়েছেন।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাছে পত্রিকা চাপে থেকেছে, এর লেখক-সাংবাদিকেরা রোষে পড়েছেন। রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার স্বার্থেই মতপ্রকাশ ও সমালোচনার প্রয়োজন আছে, এটা কোনো সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বুঝতে চাননি। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও ধসে পড়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে।

প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সমাজের দায়কেও স্বীকার করে নিয়েছে। তাই দেখা যায়, পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে এমন সব মানুষের কথা, যাঁরা নিজেদের উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। তাঁদের গল্পগুলো আরও বহু মানুষকে উদ্যমী করেছে। প্রথম আলো প্রকাশ করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক দুর্লভ নথিপত্র আর প্রবন্ধ। যুদ্ধের বিবরণ ও অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছে সরাসরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে। সহানুভূতির মন নিয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাসিডদগ্ধ মানুষের পাশে। কাজ করেছে মাদকের বিরুদ্ধে।

দীর্ঘ ২৬ বছর পার করল প্রথম আলো। বয়সের হিসাবে এই পত্রিকার এখন জেন-জির তারুণ্য। প্রথম আলো যেমন মানুষের পাশে থেকেছে, মানুষের ভালোবাসা নিয়েও প্রথম আলো তেমনি এগিয়ে চলার শক্তি পেয়েছে। প্রথম আলোর এগিয়ে চলার মধ্য দিয়ে এর পাঠক দেশ ও সমাজের অগ্রযাত্রা দেখতে পান।

প্রথম আলোর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কী আগ্রহে গণিত অলিম্পিয়াড আর ভাষা প্রতিযোগে অংশ নেয়। দেখেছি তাদের গণিতভীতি কীভাবে দূর হয়, কীভাবে তারা ভাষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। দেখেছি প্রথম আলোর সংবর্ধনায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। দেখেছি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের জয়ের তীব্র বাসনা, বিজ্ঞান উৎসবে আবিষ্কারের নেশা, বর্ণমেলায় সৃজনীচিন্তার প্রকাশ।

প্রথম আলোকে কখনো থামতে দেখিনি। যখনই দেশে বন্যা হয়েছে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা কোনো দুর্যোগ হয়েছে, প্রথম আলো সরাসরি ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পত্রিকার পাঠকেরা উদার হাতে ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করেছেন। বন্ধুসভার সদস্যরা ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন এখান থেকে সেখানে। সারা বছরই এই বন্ধুসভার মাধ্যমে তরুণেরা ভালো কাজের সঙ্গে থেকেছেন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট গঠন করে বিভিন্ন সামাজিক সহায়তামূলক কাজ করে চলেছে। যে কাজ অন্যদের করার কথা, প্রথম আলো একটি পত্রিকা হয়েও সেই কাজ করেছে। করতে হবে বলে ক্ষান্ত হয়নি, করে দেখিয়েছে। স্কুল তৈরি করেছে, শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় অংশ নিয়েছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রথম আলো হয়ে উঠেছে পত্রিকার চেয়ে বেশি। আর এসব কাজের মধ্য দিয়েই প্রথম আলো চিনিয়েছে নিজেকে।

প্রথম আলো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদানের কাজটিও করে। চলচ্চিত্র-নাটক ও সাংস্কৃতিক জগতের সেরাদের পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে দেশের তারকাদের মেলা বসে। পুরস্কার দেওয়া হয় দেশের সেরা শিক্ষক, লেখক আর খেলোয়াড়দের। প্রথম আলো দেশের বিশিষ্টজনদের ডেকে নানা বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করে। বৈঠকে উঠে আসা বক্তব্য আর প্রস্তাব তুলে ধরে কাগজে।

আরও পড়ুন

আবার প্রথম আলোর নিয়ন্ত্রণেই নিয়মিত বের হয় ছোটদের পত্রিকা, বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা। শুধু প্রচারসংখ্যা দিয়ে এগুলোর জনপ্রিয়তা বিচার করা যাবে না। এসব পত্রিকা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করে, শানিত করে। এ ছাড়া প্রথমা প্রকাশনের মাধ্যমে ছাপা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ও পাঠকপ্রিয় অসংখ্য বই। এসব বই বিষয়গত ও গুণগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

প্রথম আলো ‘ভাষারীতি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকার জগতে নজির সৃষ্টি করেছে। শুধু প্রথম আলো নয়, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনা সংস্থা প্রথম আলোর ভাষারীতিকে ‘মান্য’ মনে করে। প্রথম আলোর ছবি ও লেখার বিন্যাসে দৃষ্টিনন্দন একটা ব্যাপার আছে। বিশেষ ক্ষেত্র ও দিনকে উপলক্ষ করে বিশেষ সংখ্যা নিয়মিতভাবেই প্রকাশ করে। এর কাজের মধ্যে নীতি ও শৃঙ্খলা টের পাওয়া যায়। বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ব্যাপারটিও বোঝা যায়। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাকে ভাবিষ্যতের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে প্রথম আলো।

প্রথম আলো প্রতিদিনই খেলা, বিনোদন, পড়াশোনা আর সম্পাদকীয়র জন্য আলাদা করে পাতা রাখে। প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ ও অর্থ-বাণিজ্যের খবরের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞজনদের অভিমত ও বিশ্লেষণ। এ ছাড়া সপ্তাহের সাত দিনে কয়েক ধরনের ফিচার পাতা বের করে। নারী, শিশু, তরুণ—সবার জন্যই আলাদা পাতা আছে। পাতা আছে সাহিত্যপ্রেমী, আমোদপ্রিয় আর চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্যও। কিছু পাতার কোনো বয়স নেই, শ্রেণি নেই—সবার জন্য।

দিন দিন কাগুজে পত্রিকার চাহিদা কমছে। চাহিদা বাড়ছে ডিজিটাল ও অনলাইন সংবাদের। তবু এখন পর্যন্ত অনেক বাসায় সকালে প্রথম আলো নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে। অনেকেই আগের রাতে টেলিভিশনে দেখা সংবাদ পরদিন প্রথম আলো থেকে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন। এখনো কেউ কেউ প্রথম আলোর পাতা কেটে ছবি, খবর বা রান্নার রেসিপি কাগজে বা দেয়ালে সেঁটে রাখেন। পুরোনো পত্রিকা ওজনে বিক্রি করে দেওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখে নেন, দরকারি কিছু চলে গেল কি না!

বিগত সরকারের রোষে প্রথম আলো প্রায়ই সরকারি বিজ্ঞাপন পায়নি। এমনকি সরকারের রোষে বেসরকারি বা অন্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও কম পেয়েছে। তবে এই ‘শাপ’ই প্রথম আলোর জন্য ‘বর’ হয়েছে। কাগজে জায়গা বেড়েছে, পাঠক পড়ার জন্য বেশি উপকরণ পেয়েছেন। এই সূত্রে পত্রিকার পাঠক বেড়েছে, জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। প্রথম আলোর সমালোচক যাঁরা, তাঁরাও প্রথম আলো না পড়ে স্বস্তি পান না।

দীর্ঘ ২৬ বছর পার করল প্রথম আলো। বয়সের হিসাবে এই পত্রিকার এখন জেন-জির তারুণ্য। প্রথম আলো যেমন মানুষের পাশে থেকেছে, মানুষের ভালোবাসা নিয়েও প্রথম আলো তেমনি এগিয়ে চলার শক্তি পেয়েছে। প্রথম আলোর এগিয়ে চলার মধ্য দিয়ে এর পাঠক দেশ ও সমাজের অগ্রযাত্রা দেখতে পান।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।