২০১৯ সালে ১ জুলাই উচ্চ আদালত দেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা স্বীকৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন। ওই রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ক, ২১, ৩১ এবং ৩২ একত্রে পাঠে এটা কাচের মতো স্পষ্ট যে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সব উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ–নদী, খালবিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিগুলো বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব নাগরিকের জন্য সংরক্ষিত।’ একই রায়ে উল্লিখিত সম্পত্তির মালিক জনগণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার শুধু এ সম্পদের রক্ষক।
১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো আইনেই সরকারের কোনো কর্মকর্তাকে নাগরিকের সম্পত্তি ব্যক্তিবিশেষের নামে লিখে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) কিংবা এসএ (স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে) রেকর্ডে যা নদী, খাল, বিলসহ উল্লিখিত শ্রেণিতে রেকর্ড হয়েছে তার শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত কেন সুযোগ নেই, ব্যক্তির নামে লিখে নেওয়ারও বিধান নেই।
যদি কেউ কোনো উপায়ে এসবের মালিকানা লাভ করেন, তা কার্যত অবৈধ। কখনো কখনো কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে এসব সম্পত্তির মালিক ব্যক্তি হয়েছে, কখনোবা ব্যক্তির নামে কবুলিয়াত সূত্রে দেওয়া হয়েছে। এসব সম্পত্তির মালিক যেহেতু সরকার নয়, দেশের সব নাগরিক মালিক, তাই সরকারের পক্ষে এসব সম্পত্তি ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী। এসব সম্পত্তিতে দেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার উল্লেখ করে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকের এই মালিকানা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত।’
সংবিধান, আইন, বিধি—সবকিছু লঙ্ঘন করে দেশের হাজার হাজার হেক্টর জমি যা নদী, খাল, বিলসহ উল্লিখিত সম্পদ; তা ভুলক্রমে কিংবা জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যক্তির নামে লিখিত হয়েছে। এমনকি ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির ফাঁকফোকর দিয়ে সেগুলো নতুন রেকর্ডে ব্যক্তির নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এসব উদ্ধারে সরেজমিন আন্দোলন করছি প্রায় ১৫ বছর ধরে। আন্দোলনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তারা নাগরিকের সম্পত্তি উদ্ধারে তৎপর হচ্ছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একই পদ্ধতির দখল করা জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও কোথাও উদ্ধারের সহজতম প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে।
রংপুরের মিঠাপুকুরের শালমারা নদীতে কয়েক একর জমি ব্যক্তির নামে লিখিত হয়েছিল। সেখানে রিভারাইন পিপলের শালমারা নদী সুরক্ষা কমিটি আন্দোলন করছে। তিন বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ব্যক্তির নামে বরাদ্দ করা জমির ব্যক্তিমালিকানা বাতিল করে দেন। মালিকানা বাতিল করার পর রেকর্ড সংশোধনের কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন।
রংপুরের বুড়াইল নামে যে নদীটির ওপর দিয়ে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক চলে গেছে, সেই নদীতে প্রায় ২৮টি বাঁধ ছিল। রংপুর বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটির নির্দেশে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ২০২৩ সালে বুড়াইল নদীর সব বাঁধ রেকর্ড সংশোধনের আগে অপসারণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেতু ছাড়া আড়াআড়ি সড়ক ছিল, সেই সড়কও উচ্ছেদ করা হয়েছে।
সাধারণত দেখা যায়, ৫০-৬০ বছর আগে অবৈধ দখলদারেরা মামলার রায়ে জয়লাভ করে মালিক হয়েছে মর্মে দাবি করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা কবুলিয়াত বা অন্য কোনোভাবে ব্যক্তির নামে দিয়েছেন। যেমন রংপুরের খটখটিয়া নদীর প্রবাহের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ একর জমি কবুলিয়াত সূত্রে ব্যক্তির নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
নদী উদ্ধার প্রক্রিয়া অভিন্ন হওয়া প্রয়োজন। যদি রেকর্ড সংশোধন করার পর জমি উদ্ধার করতে হয়, তাহলে ঢাকার বড় বড় স্থাপনা কীভাবে ভেঙে দেওয়া হলো? সেসব ভবনমালিকদেরও তো রেকর্ডপত্রে নিজেদের নাম ছিল। নাগরিকের সম্পত্তি থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা আর রেকর্ড সংশোধন করা বিপরীতমুখী নয়। বরং আগে ব্যক্তির মালিকানা বাতিল করতে হবে। আগেই রেকর্ড সংশোধনের মামলা করলে সেই রেকর্ড সংশোধন হতে যুগের পর যুগ লেগে যেতে পারে।
যে ক্ষমতা যে কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়নি, তিনি সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করলেই নাগরিকের সম্পত্তি ব্যক্তির নামে হতে পারে—এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। যেহেতু নদী, খাল, বিলসহ উল্লিখিত সম্পত্তি ব্যক্তি মালিক হওয়ার প্রক্রিয়া অবৈধ এবং ভুল। তাই মালিকানা প্রথমত বাতিল করতে হবে। এই বাতিলপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক-দেড় সপ্তাহের বেশি লাগার কথা নয়। এসএ কিংবা আরএস রেকর্ড ব্যক্তির নামে যদি হয়, তাহলে সেই রেকর্ড সংশোধনও করতে হবে। তবে এটি মনে করার কারণ নেই যে রেকর্ড সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সরকারের জমি থেকে ব্যক্তিকে উৎখাত করা যাবে না।
নদী উদ্ধার প্রক্রিয়া অভিন্ন হওয়া প্রয়োজন। যদি রেকর্ড সংশোধন করার পর জমি উদ্ধার করতে হয়, তাহলে ঢাকার বড় বড় স্থাপনা কীভাবে ভেঙে দেওয়া হলো? সেসব ভবনমালিকদেরও তো রেকর্ডপত্রে নিজেদের নাম ছিল। নাগরিকের সম্পত্তি থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা আর রেকর্ড সংশোধন করা বিপরীতমুখী নয়। বরং আগে ব্যক্তির মালিকানা বাতিল করতে হবে। আগেই রেকর্ড সংশোধনের মামলা করলে সেই রেকর্ড সংশোধন হতে যুগের পর যুগ লেগে যেতে পারে।
বুড়াইল নদীতে অবৈধভাবে ব্যক্তির নামে রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও ২৮টি বাঁধ উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদের পর এখন সেসব রেকর্ড সংশোধনের কাজ হবে। শালমারা নদীতেও সেই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে নদীর পার থেকে কোটি কোটি টাকার অবৈধ স্থাপনাও ভাঙা হয়েছে একইভাবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অবৈধভাবে কখনো নদী, খাল, বিলসহ উল্লিখিত সম্পত্তির মালিক ব্যক্তি হতেই পারে না।
সরকারের উল্লিখিত সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা থাকলে প্রথমেই তা উচ্ছেদ করতে হবে। এরপর অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় নদী, খাল, বিলসহ উল্লিখিত নাগরিকের সম্পত্তি সহজে উদ্ধার করা সম্ভব।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক