সাবেক দুজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার নানা ধরনের সম্পদের হিসাব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের অবিশ্বাস্য সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করে একটি পত্রিকা। এরপর দুদক এ নিয়ে তদন্তে নামে এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। দুদকের তদন্তে বরং আরও নতুন নতুন সম্পদের খোঁজ বের হয়েছে।
এরই মধ্যে আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের খবর। আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের যে হিসাব সংবাদমাধ্যমে বের হয়েছে, তা অবশ্য বেনজীরের তুলনায় কম, কিন্তু সাবেক এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের পরিমাণ সাধারণ বিবেচনায় অস্বাভাবিক। এ সম্পদ তাঁরা কীভাবে অর্জন করেছেন, এগুলো বৈধ না অবৈধ, তা যথাযথ তদন্ত হলেই জানা যাবে।
ঘটনা দুটি বিবেচনায় নিলে বিশেষ একটি পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। বেনজীরের ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া হয়নি, আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের বিবরণ প্রকাশের পর তা হতে শুরু করেছে। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বড় ধরনের অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।
আলোচনায় এসেছে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে তাদের তীব্র অসন্তোষই প্রকাশ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের আমলে গত ১৫ বছরের যাঁরা আইজিপি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেনজীর আহমেদ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী। সরকারঘনিষ্ঠ সাবেক এই আইজিপির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এ প্রশ্নের একক বা সঠিক জবাব কারও জানা আছে কি না, জানি না। তবে এটা পরিষ্কার যে রাজনৈতিক কোনো হিসাব-নিকাশ বা বিবেচনা থেকেই সরকারকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবশ্যই দুর্নীতির, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি যেহেতু ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে বিবেচিত, সম্ভবত সে কারণেই এ নিয়ে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে শুরুতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি।
কিন্তু আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের বিষয়টি প্রকাশ হওয়া সেই অর্থে ‘রাজনৈতিক’ নয়। এখানে মূল ইঙ্গিতটি দুর্নীতির দিকে। সংখ্যাটি যা–ই হোক, পুলিশে এমন কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছেন, যাঁরা দুর্নীতিতে জড়িত। তাঁরা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ করেছেন বা করে চলেছেন।
আছাদুজ্জামান মিয়ার ঘটনা তাঁদের নাড়া দেবে, এটাই স্বাভাবিক। পুলিশের মধ্যে এত ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাদের চরম ক্ষোভের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, পুলিশ বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, ‘ঢালাও’ ও ‘অতিরঞ্জিত’। তারা এটাও মনে করে যে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও দেশবিরোধী চক্র যেমন পুলিশ বাহিনীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সমালোচনায় লিপ্ত, তেমনি কোনো কোনো গণমাধ্যমও পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্যদের ব্যাপারে মানহানিকর নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে একই ভূমিকা পালন করছে।
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্যের সূত্র ধরে এটা বলা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্রে দুজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে এবং আদালতের নির্দেশে তাঁর ও তাঁর পরিবারের অনেক সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব ইতিমধ্যেই জব্দ করা হয়েছে।
আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের খবর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সেই সূত্রে প্রথম আলো পত্রিকাও একটি প্রতিবেদন করেছে। সেই প্রতিবেদনে সাংবাদিকতার নীতি–নৈতিকতা মেনে আছাদুজ্জামান মিয়ার বক্তব্য দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর কী কী সম্পদ রয়েছে, এর বিবরণ তিনি নিজেও দিয়েছেন।
মূলত যে দুটি ঘটনার জের ধরে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন তাদের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ‘ঢালাওভাবে’ অভিযুক্ত করার দায়ে সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করেছে, সে সূত্রে সাংবাদিকদের তরফে তো এ প্রশ্ন তোলা যায় যে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’ শক্তির সঙ্গে এক করে দেখা কি অনেক বেশি ‘ঢালাও’ হয়ে গেল না?
কোন পত্রিকায় বা কোন প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত, ঢালাও বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু লেখা হয়েছে, এর কোনো দৃষ্টান্ত যদি পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে উল্লেখ থাকত, তাহলে হয়তো সাংবাদিকেরা ‘উপকৃত’ হতেন। কারণ, বিবৃতিতে পুলিশ বাহিনী সম্পর্ক প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন ও সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা মেনে চলতে সংবাদমাধ্যমকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের অবিশ্বাস্য সম্পদের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দুদক তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে বাহিনী হিসেবে পুলিশের বরং উচিত ছিল এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো। আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের ব্যাপারেও দুদকে তদন্তে উৎসাহিত করা। পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার এটাই সবচেয়ে কার্যকর পথ। কিন্তু পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে মনে হচ্ছে, তারা উল্টো পথ ধরেছে।
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের দীর্ঘ বিবৃতিতে নানা কিছু বলা হলেও সামগ্রিকভাবে তাদের চাওয়ার বিষয়টি বেশ পরিষ্কার। এই চাওয়া হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি, অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন বা কোনো অভিযোগ নিয়ে কিছু লেখা যাবে না। এমনকি সাংবাদিকতার সাধারণ নীতি–নৈতিকতা মেনেও তা করা যাবে না। এটা উদ্বেগজনক চাওয়া এবং সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি চাপ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, পুলিশ দেশের একটি প্রভাবশালী বাহিনী এবং সরকারের বিশেষ শক্তি।
সংবাদমাধ্যমের কাজই হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজের কোথায় কী অনিয়ম হচ্ছে, কোথায় অসংগতি আছে, তা তুলে ধরা এবং তা করতে হয় সাংবাদিকতার প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা মেনে। তবে সব সংবাদমাধ্যমই যে তা মেনে চলে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু করে না, এমনও নয়। সে ক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে একধরনের চাপ তৈরি চেষ্টা আছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশে কেউ যতক্ষণ ক্ষমতায় বা পদে আছেন, দুর্নীতি করলেও তাঁরা অনেকটাই নিরাপদ। বিপদে পড়তে পারেন পদ বা ক্ষমতা হারানোর পর। পদে থাকতে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি, আছাদুজ্জামান মিয়া ও তাঁর পরিবারের সম্পদ নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়নি। অবসরে যাওয়ার পর সম্পদের হিসাব বের হওয়ার একটি ধারা যদি তৈরি হয়, তাহলে এখন যাঁরা দুর্নীতি করছেন, তাঁদের অনেকেই সামনে বিপদে পড়তে পারেন। পুলিশের মধ্যে এত প্রতিক্রিয়ার পেছনে কি এই ভয় কাজ করছে?
আছাদুজ্জামান মিয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই কিছু কিছু কর্মকর্তার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তাঁরা এর সঙ্গে পুলিশের ভাবমূর্তিকে এক করে দেখার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আছাদুজ্জামান মিয়া দাবি করেছেন, বৈধ আয়েই তাঁর ও তাঁর পরিবারের সব সম্পদ কেনা হয়েছে। এতে তো পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার কাজটি সহজ হয়ে গেল। এখন যা দরকার, তা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য ও যথাযথ তদন্ত। সেখানে যদি প্রমাণিত হয় যে মিয়া ও তাঁর পরিবারের এই বিপুল সম্পদ বৈধ আয়ের মাধ্যমেই হয়েছে, তাহলে তো তা পুলিশের ভাবমূর্তির পক্ষে যাবে।
কোনো পুলিশ কর্মকর্তার অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন বা দুর্নীতির অভিযোগকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো বাহিনী দুর্নীতি করতে পারে না, দুর্নীতি করে ব্যক্তি। ব্যক্তির দুর্নীতিকে বাহিনীর ভাবমূর্তির সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে তা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির পরিপন্থী।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের অবিশ্বাস্য সম্পদের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দুদক তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে বাহিনী হিসেবে পুলিশের বরং উচিত ছিল এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো। আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের ব্যাপারেও দুদকে তদন্তে উৎসাহিত করা। পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার এটাই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
কিন্তু পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে মনে হচ্ছে, তারা উল্টো পথ ধরেছে। এখন এই বিবৃতির পর যদি সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পদের হিসাব নিয়ে আর কোনো নাড়াচাড়া না হয়, দুদক যদি নিষ্ক্রয় হয়ে পড়ে, অস্বাভাবিক সম্পদ গড়ে তোলা বা দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও যদি পত্রপত্রিকায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নামে প্রতিবেদন ওঠা বন্ধ হয়ে যায়, সেটাই বরং পুলিশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করবে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]