রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর গোটা ইউরোপ যখন হকচকিত, তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার ট্রান্স আটলান্টিক অংশীদার তথা ইউরোপের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে একটি নতুন ধরনের ঠান্ডা যুদ্ধের উদ্ভব হয়েছে এবং এখন মহাদেশটি আক্ষরিকভাবে এবং রূপকভাবে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া ও আমেরিকার এ নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে কীভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা নিয়ে নিজেরাই বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ইউক্রেন যে লড়াই চালাচ্ছে, তার প্রতি ইউরোপীয়রা দৃঢ় সমর্থন দিয়ে গেলেও এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইউরোপীয়রাও সেই সমর্থনদানের পরিণতির ফাঁদে পড়ে গেছে।
হাঙ্গেরির মতো কোনো কোনো দেশ ইউরোপে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত উপস্থিতির অনুমোদন দেওয়ার পক্ষে। আবার সুইডেন এবং পোল্যান্ডের মতো কিছু দেশ আমেরিকাকে ইউরোপে অধিকতর সুযোগ দিতে চায়। কিন্তু ইউরোপ নামক এই মহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিগুলো রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে বৃহত্তর অর্থে স্বাধীনতা চায়।
ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করে ন্যাটো সম্প্রসারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ দিয়ে আসছে, ফ্রান্স ও জার্মানি দীর্ঘদিন ধরে তার বিরোধিতা করে আসছে। এ দুটি দেশ দৃঢ়ভাবে মনে করে, বাইডেন প্রশাসন আমেরিকার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের (ফ্রান্স ও জার্মানি) অর্থ ব্যয় করে রাশিয়াভীতি ছড়াচ্ছে। ইউরোপে শীতল যুদ্ধের ধাঁচের একটি নিরাপত্তাকাঠামো বিনির্মাণের জন্য আমেরিকা চাপ দিচ্ছে।
জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর এবং রপ্তানি ও বিনিয়োগের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া জার্মানি মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন বা সীমিত করার মার্কিন প্রচেষ্টায় খুবই অসন্তুষ্ট। চলতি মাসের শুরুতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের চীন সফরের লক্ষ্য ছিল জার্মান-চীনা সম্পর্কের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা।
বার্লিন হয়তো এই শীতের জন্য তার গ্যাসের মজুত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু জ্বালানির চাপ এবং আকাশছোঁয়া দাম জার্মান এবং অন্যান্য ইউরোপীয় অর্থনীতিকে ক্ষুণ্ন করছে। গ্যাসের দাম তাদের দীর্ঘমেয়াদি গড় দাম থেকে ছয় গুণ বেশি হয়েছে এবং ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় ২০২৩ সাল মহাদেশটি কীভাবে চলবে তা স্পষ্ট নয়।
অস্বাভাবিকভাবে, বাইডেন ট্রান্স আটলান্টিক অংশীদারত্বের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বদলে তিনি ট্রান্স আটলান্টিক আস্থার সংকট তৈরি করছেন। প্রকৃতপক্ষে, জর্জ বুশের যুদ্ধ, বারাক ওবামার উদাসীনতা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত্রুতা ইউরোপীয় সংহতির পথে যতটা না বাধা তৈরি করেছিল, তার চেয়ে বড় বাধা তৈরি করেছে ইউরোপকে বাইডেনের শক্ত আলিঙ্গন।
জ্বালানিসংকট ও তীব্র শীতের মিলিত অবস্থা ইউরোপজুড়ে এক লাখ অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ হতে পারে যা ইউক্রেনের সামরিক সংঘাতজনিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও বেশি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করার বদলে তার অভ্যন্তরীণ বাজারদরের চার গুণ বেশি দামে ইউরোপীয়দের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করছে।
ইতিমধ্যে বাইডেনের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন মার্কিন করপোরেট জায়ান্টদের শত শত বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়ে তাদের ইউরোপীয় প্রতিযোগীদের কোণঠাসা করছে। এ সবই ইউরোপীয়দের এমন অভিযোগ করতে উসকানি দিচ্ছে যে আমেরিকা এ যুদ্ধ থেকে মুনাফা খাচ্ছে এবং ইউরোপীয়দের বিনিয়োগগুলোর ন্যায্য ও অবাধ বাণিজ্যকে ক্ষুণ্ন করছে। সংক্ষেপে তারা এটিকে চীনের নীতির অনুলিপি হিসেবে আখ্যায়িত করছে এবং এ প্রশ্ন জাগিয়ে তুলছে: এমন বন্ধু থাকলে আর বেইজিংয়ের কী দরকার?
এটিই ক্রমে খোলস থেকে বেরিয়ে আসা আমেরিকার ট্রান্স আটলান্টিক নাটক যা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁকে ইইউকে ‘জাগিয়ে তোলার’ আহ্বান জানাতে প্ররোচিত করেছিল। কারণ, মাখোঁর ভাষায় ‘আমেরিকান বা চীনারা কেউই আমাদের কোনো দুর্বলতাকে সারিয়ে তুলবে না’। অন্য ইউরোপীয় নেতারাও এখন দাবি করা শুরু করেছেন, ওয়াশিংটন যেন ট্রান্স আটলান্টিক জোটের জন্য অত্যাবশ্যক কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ এবং সমন্বয় করে নেয়। কিন্তু হায়, ইউরোপিয়ানরা সবাই যখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন এ দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও পরামর্শ খুব কমই করেছে।
ইইউর ২৭টি সদস্যরাষ্ট্র সবগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সম্মত না–ও হতে পারে। তবে প্যারিস এবং বার্লিনকে অবশ্যই একজোট হতে হবে, যদি তারা সংকট মোকাবিলায় সফল হতে চায়। আমেরিকা ইউরোপীয়দের নিষ্ক্রিয়তা ও বিভাজনের সুযোগ নিতে দ্বিধা করেনি।
অস্বাভাবিকভাবে, বাইডেন ট্রান্স আটলান্টিক অংশীদারত্বের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বদলে তিনি ট্রান্স আটলান্টিক আস্থার সংকট তৈরি করছেন। প্রকৃতপক্ষে, জর্জ বুশের যুদ্ধ, বারাক ওবামার উদাসীনতা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত্রুতা ইউরোপীয় সংহতির পথে যতটা না বাধা তৈরি করেছিল, তার চেয়ে বড় বাধা তৈরি করেছে ইউরোপকে বাইডেনের শক্ত আলিঙ্গন।
তিনি যা করছেন, তা ইউরোপের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
আদতে বাইডেন ইউরোপে আমেরিকার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব পুনরুদ্ধার করার জন্যই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের প্রশ্নে ওয়াশিংটন শত্রু এবং বন্ধুদের প্রতি একই তালে নির্দয় আচরণ করে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আমেরিকার সেই চেহারা দেখেছিল যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ব্ল্যাকমেল করেছিল।
কিন্তু আজকের দিনে এটিকে বুদ্ধিদীপ্ত কাজ বলা যায় না। একটি ক্রমবর্ধমান বহুমুখী বিশ্বে লড়াইরত রাশিয়া এবং উদীয়মান চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে আমেরিকার দরকার হবে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ; দুর্বল ও বিভক্ত ইউরোপ নয়।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারওয়ান বিশারা আল–জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক