বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হতাশাজনক অবস্থান অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কিন্তু পাবলিক ডিসকোর্স অনুসরণ করলে মনে হবে, বাংলাদেশে শুধু শিক্ষা খাত পিছিয়ে আছে আর সব ক্ষেত্র যেন বিশ্বমানের। এ ছাড়া আরও একটি ভাষ্য প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সেটি হলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকার জন্য শুধু শিক্ষকমণ্ডলী দায়ী। এমনকি বিভিন্ন সময়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত নামীদামি শিক্ষকেরাও ঢালাওভাবে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিক্ষকদের চরিত্র হরণ করেন, যা খুবই দুঃখজনক।
পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা তুলনা করা হয়, তাহলে তাঁদের সমালোচনার অসারতা প্রমাণিত হবে। এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না, জানা নেই। তবে এটা অনুমান করা যেতে পারে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের তুলনায় আমাদের অর্জন একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আর যদি এই অনুমান অসার হয়, তাহলে তা প্রমাণের দায়িত্ব তাঁদের, যাঁরা শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত সমালোচনা করেন।
ইদানীং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে তাতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে বটে, কিন্তু এর ফলে শিক্ষার কতটুকু ফলপ্রসূ উন্নয়ন হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কেননা এসব প্রকল্পের সঙ্গে নানা রকম শর্ত জড়িত থাকে যেগুলোর সঙ্গে শিক্ষার মৌলিক উন্নয়নের সম্পর্ক তর্কসাপেক্ষ। বিশেষত এসব প্রকল্পের প্রায় সিংহভাগই বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বা আচার অনুষ্ঠানে ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষকদের গবেষণা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলোর আদৌ তেমন কোনো অবদান চোখে পড়ে না। এমনকি তথাকথিত ‘ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট’-এর নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাময়িক মেয়াদে শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদান করে আদৌ কতটুকু ফল হচ্ছে বা হবে, তা অনিশ্চিত।
তা ছাড়া আমাদের বাংলাদেশিদের চিরায়ত ঔপনিবেশিক দাসত্বের মনোবৃত্তি থেকে প্রায়ই আমরা বিদেশে কর্মরত শিক্ষকদের বাংলাদেশি কর্মরত শিক্ষকদের থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণী বলে মনে করি; এ ধারণার কোনো ভিত্তি থাকুক বা না-ই থাকুক। বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে বাংলাদেশে কর্মরত শিক্ষকেরা দেশে ফিরে আসেন শুধু বিদেশের সুযোগের অভাবে—এ রকম অতিসরলীকরণ প্রসূত ধারণাটিও সর্বজনীনভাবে সত্যি নয়। এখানে দেশ বা বিদেশে কর্মরত হওয়ার থেকে শিক্ষকের গবেষণাগত উৎকর্ষটাই মুখ্য বিবেচ্য হওয়া উচিত।
শিক্ষকদের অযোগ্যতা ও পেশাদারির চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হলো উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব বা অতিনিয়ন্ত্রণ বা ক্ষেত্রবিশেষে স্বেচ্ছাচারিতা। বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা হচ্ছে একটা লাইফস্টাইল। আর বাংলাদেশে এটি একটি পেশা, যেখানে যথাযথ মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধার অভাব আছে। এ দেশে আজ থেকে ২০ বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাইতেন। আজ অনেক ক্ষেত্রে এই প্রবণতাটা সত্য নয়। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা এমনকি ভারত বা পার্শ্ববর্তী অন্য দেশগুলোর থেকেও অনেক সীমিত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা এখনো অনেক কম এবং অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ণকালীন শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা থাকলেও সমাজের বিভিন্ন ক্ষমতাশালী পেশাজীবীদের খণ্ডকালীন শিক্ষার ব্যাপারে অসীম উৎসাহ লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে তখন গণ্যমান্য পেশাজীবীদের আর প্রশ্ন তুলতে দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। শিক্ষকেরা শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা বাদ দিয়ে কনসালট্যান্সির সঙ্গে জড়িত থাকেন বলে ঢালাও অভিযোগ করা হয়। কিন্তু অন্য পেশাজীবীরা তাঁদের মূল কাজ ফেলে শিক্ষা বিতরণে জড়িত হলে তাদের ব্যাপারে এ সমালোচনা শোনা যায় না। কারণ, তাঁরা সব্যসাচী, আর শিক্ষকেরা সীমিত সামর্থ্য ও সীমিত মেধার।
উচ্চশিক্ষার মান যদি এত হতাশাজনক হতো, তবে বাংলাদেশ থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন নামীদামি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারতেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে
এমনকি অনেক পেশাজীবীর এ ব্যাপারে ধারণা আছে বলে মনে হয় না যে, শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন যতটুকু সময় নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় তাঁদের ব্যয় করতে হয় পাঠদান প্রস্তুতি, গবেষণাকর্ম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে। একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজের একটা বড় অংশই কাটে শ্রেণিকক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে বাইরে; পাদপ্রদীপের আড়ালে। শিক্ষককে অফিসকক্ষে পাওয়া যায় না এ ধরনের সমালোচনা মিথ্যা না হলেও শিক্ষকতাকে নয়টা-পাঁচটা অফিসের সঙ্গে তুলনা করা শিক্ষা সম্বন্ধে স্বল্প ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষকদের পেশাদারির অভাব অনেক ক্ষেত্রে আছে এটা অনস্বীকার্য, কিন্তু বাংলাদেশ কোনো পেশার মানুষদের পেশাদারির পরাকাষ্ঠা দেখা যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ নিঃসন্দেহে সমালোচনার দাবি রাখে, কিন্তু এই প্রবণতাগুলো সমাজের সার্বিক দুর্বৃত্তায়নের আলোকে বিবেচনা করতে হবে।
বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ দেশের অনেক শিক্ষকই বিশ্বের বিভিন্ন সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন, আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। উচ্চশিক্ষার মান যদি এত হতাশাজনক হতো, তবে বাংলাদেশ থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন নামীদামি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারতেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। অবশ্যই শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সাফল্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের যেসব নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা পরে ভর্তি হন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং তাঁদের সেখানকার শিক্ষকমণ্ডলীর মুখ্য অবদান আছে, কিন্তু এই শিক্ষার্থী তৈরিতে বাংলাদেশি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বা শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই তা বলা বোধ করি অসংগত হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থান অধিকারকারী দেশগুলোর কোথাও শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে অ-শিক্ষক বা নামমাত্র শিক্ষকদের বাংলাদেশের মতো আধিপত্য দেখা যাবে বলে মনে হয় না। শিক্ষকের হাতে শিক্ষাব্যবস্থার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীনতা; বরং এর অর্থ হচ্ছে যে, যার যে কাজটি করার কথা, তাকে সেটি করতে দেওয়া। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা-সংক্রান্ত নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক বা রিপোর্টিং কোনো কিছুরই তেমন কোনো অভাব আছে বলে প্রতীয়মান হয় না; অভাব যার রয়েছে, তা হলো শিক্ষকদের যোগ্য সম্মান, গবেষণা করার যথাযথ পরিবেশ, পর্যাপ্ত স্বাধীনতা। যদি এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়, তারপরেই বাংলাদেশের শিক্ষকদের সমালোচনা যথার্থ এবং অর্থবহ হবে।
মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।