গবাদিপশুর মাধ্যমে উৎপাদিত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কৌশল

গবাদি পশু কৃষি খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে এগুলোর দ্বারা উৎপাদিত গ্রিনহাউস গ্যাস (গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে রয়েছে মিথেন, কার্বন ডাই–অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও ওজোন) বিশেষ করে মিথেন পরিবেশদূষণের একটি বড় কারণ। গবাদিপশু, বিশেষত রুমেন্ট প্রাণী, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রায় ১৫-২০ শতাংশ এর জন্য দায়ী—এটি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো এই গ্রিনহাউস গ্যাস।

গবাদিপশু—বিশেষত গরু, মহিষ প্রভৃতি প্রাণী মিথেন গ্যাস নির্গত করে। এসব প্রাণীর হজমপ্রক্রিয়ায় ‘অ্যান্টারিক ফারমেন্টেশন’ নামে একটি প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া গবাদিপশুর গোবর থেকেও নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন নির্গত হয়। তাই গবাদিপশু পালন থেকে উৎপন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।

রুমেন্ট প্রাণী দ্বারা উৎপাদিত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কৌশল হলো:

ক) পুষ্টি/উন্নত খাদ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল। যেমন ১. প্রাণীর খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এনে নির্গত মিথেনের পরিমাণ কমানো সম্ভব। উচ্চমানের খাদ্য প্রদান। যেমন শস্য ও চারণভূমি ব্যবহারের পরিবর্তে বিশেষ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য দিলে মিথেন উৎপাদন হ্রাস পায়। অ্যামোনিয়া ও মোলাসেস (চিটাগুড়) খাদ্যে যোগ করা হলে প্রাণীর হজমক্ষমতা বাড়ে এবং মিথেন গ্যাসের উৎপাদন কমে।

২. আয়োনোফোর একধরনের অণু যা প্রাণীর পাচনপ্রক্রিয়ায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং মিথেন গ্যাসের উৎপাদন কমায়।

৩. প্রোপিওনেট এনহ্যান্সার প্রাণীর খাদ্যতন্ত্রে প্রোপিওনেটের উৎপাদন বাড়িয়ে মিথেন গ্যাসের উৎপাদন কমাতে সাহায্য করে। প্রোপিওনেট শক্তি উৎপাদনকে উন্নত করে এবং গ্যাস নির্গমন কমায়।

৪. তেল ও ট্যানিনের সাপ্লিমেন্ট প্রাণীর খাদ্যে মিথেন নির্গমনের প্রক্রিয়া কমিয়ে দেয় এবং প্রাণীর পুষ্টিমান উন্নত করে।

৫. গবাদিপশুর খাদ্যতন্ত্রে, প্রোটোজোয়া (এককোষী জীব) বা অন্যান্য মাইক্রোঅর্গানিজম পাচনতন্ত্রে মিথেন গ্যাস উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে এবং ডিফনেশনের মাধ্যমে সেগুলোর সংখ্যা কমানো গেলে মিথেন নির্গমন কমানো সম্ভব হয়।

খ. ব্যবস্থাপনা কৌশল: ১. ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ বা অবনমিত ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাণী চারণের চাপ কমাতে হবে।

২. উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মিথেন নির্গমন কমাতে উচ্চ কার্যকর প্রাণী বেছে নেওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে প্রাণিসম্পদের প্রজাতি পরিবর্তনের কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে।

৩.  যখন ঘাসজাত খাবার সূক্ষ্মভাবে গুঁড়ো বা পেলেট করা হয়, তখন মিথেনোজেনেসিসের মাত্রা কম থাকে অর্থাৎ সহজপাচ্য খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা যায়।

৪. উচ্চ উৎপাদনশীল প্রাণী প্রজাতি প্রজননের মাধ্যমে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রাণী থেকে বেশি দুধ বা মাংস উৎপাদন সম্ভব; ফলে প্রাণীর সংখ্যা কমানোর মাধ্যমে গ্যাস নির্গমন কমানো যায়।

৫. একীভূত পদ্ধতিতে একই জমিতে গাছপালা ও প্রাণী উৎপাদন এক অসাধারণ কৌশল, যা পরিবেশ ও কৃষি উভয়ের জন্যই লাভজনক। এই পদ্ধতি কার্বন সঞ্চয় বৃদ্ধি করে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমায় এবং মিথেন নির্গমনের মাত্রা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. সঠিক পদ্ধতিতে গো–বর্জ্য  সংরক্ষণের মাধ্যমে মিথেন সংগ্রহ করা যাবে। প্রাণীর গোবর থেকে নির্গত গ্যাস কমাতে উন্নত বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে গোবর থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যা পরিবেশবান্ধব।

গ) অন্যান্য কৌশল: ১.  টিকাদান গবাদিপশুর ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপিত করবে, যাতে মিথেন উৎপাদনকারী মিথানোজেনগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

২. পুনঃসংযোজন প্রযুক্তি গবাদিপশুর বর্জ্য বা মল পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জৈব পণ্য (যেমন সার বা বায়োগ্যাস) হিসেবে রূপান্তর করে। এটি পরিবেশের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমিয়ে শক্তির পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস করে।

৩. কার্বন সিঙ্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবাদিপশু পালনের অঞ্চলে গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে পরিবেশে মিথেনের প্রভাব কিছুটা কমে।

৪. গবাদিপশু পালনকারীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করতে উৎসাহিত করা উচিত।

পরিশেষে গবাদিপশু পালন থেকে উৎপন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য উন্নত খাদ্য, আধুনিক প্রযুক্তি এবং সচেতনতার মিশ্রণ প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষার জন্য এসব কৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।

  • এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স) এবং পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। akmhumayun@cvasu.ac.bd