বছর কয়েক আগেও চীনের অর্থনৈতিক বাস্তবতা আহামরি কিছু ছিল না। তবে দ্রুত তারা প্রবৃদ্ধির শিখরে উঠে আসে। চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক ‘ফলন’ ১৯৯২ সালে ছিল ৫০ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে ১৮ লাখ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ১৯৯২ সালে দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল ৪০০ ডলার, যা ২০২২ সালে ১৩ হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রবৃদ্ধির গতি অনেকটাই মন্থর হয়ে এসেছে।
চীন উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র ও বেশির ভাগ উন্নত বিশ্বের সহযোগিতা পেয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) চীনকে স্বাগত জানানোর সুবাদে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো চীনে বিনিয়োগ করেছে এবং বেইজিংয়ের ঋণ সুবিধার মাত্রা সম্প্রসারিত করেছে এবং তাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি দিয়েছে।
চীন যখনই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি করেছে, ডব্লিউটিওকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে এবং বিদেশি প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলার জন্য তার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে গোপন করে রেখেছে, তখন পশ্চিম তা দেখেও না দেখার ভান করেছে। যে অর্থনৈতিক হিসাব–নিকাশ পশ্চিমকে এই প্রবণতার দিকে ঝুঁকতে আংশিকভাবে হলেও অনুপ্রাণিত করেছিল, সেটি হলো চীনের ১৪০ কোটি ভোক্তার একটি বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকার। পশ্চিম নীতিগতভাবে ধরে নিয়েছিল, চীন যত ধনী হবে, তার জনগণ পশ্চিমাদের কাছ থেকে তত বেশি পণ্য কিনতে সক্ষম হবে।
চীনের কম মজুরির শ্রমশক্তি বহুজাতিক করপোরেশনগুলোকে কম খরচে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করতে সক্ষম করেছে। এটি তাদের মুদ্রাস্ফীতি কমিয়েছে ও ভোক্তাদের কেনার সামর্থ্য বাড়িয়েছে।
পশ্চিমের অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে একটি রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করেছে। সেটি হলো: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আশা করেছিল, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে উদার জায়গায় নিয়ে আসবে। অনেকেই মনে করেছিল, চীন ধনী হয়ে উঠলে তা অধিকতর উন্মুক্ত, গণতান্ত্রিক ও বাজারবান্ধব হবে।
অনেকের এই বিশ্বাসও ছিল যে চীন যেহেতু পশ্চিমা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে লাভবান হচ্ছে, সেহেতু তার উত্থানে অবদান রাখা সম্পর্কগুলোকে রক্ষা করার জন্য বেইজিং বাইরের শক্তিগুলোর সঙ্গে সংযম বজায় রেখে কাজ করবে। আশা করা হয়েছিল, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে চীন এই বিশ্বব্যবস্থার রেওয়াজ-রীতির মধ্যে থেকে একটি ‘দায়িত্বশীল অংশীদার’ হয়ে উঠবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আশাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। দামে সস্তা চীনা রপ্তানি পণ্য পশ্চিমে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলোকে হটিয়ে দেওয়ার কারণে সেসব জায়গার স্থানীয় মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে।
অন্যদিকে চীন দেশের মধ্যে কিংবা দেশের বাইরে অধিকতর উন্মুক্ত বা উদার তো হয়ইনি, বরং উল্টোটা হয়েছে। ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও পণ্য চীনের কাছে রপ্তানি করার বিষয়ে এবং তাদের কোম্পানিগুলোকে চীনে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি বাছবিচারি হয়ে উঠেছে।
পশ্চিমের এই নিয়ন্ত্রণ ও বাছবিচার চীনের প্রবৃদ্ধির গতিকে মন্থর করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তবে চীনের অর্থনৈতিক শ্লথগতির প্রধান কারণগুলো অভ্যন্তরীণ। অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগ (বিশেষ করে অবকাঠামো খাত) ও রপ্তানি, স্ফীত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ এবং বেলুনের মতো ফেঁপে ওঠা ঋণের অর্থের ওপর চীনা অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করার বিষয়টি চীনকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছে।
এ অবস্থায় চীনের সামনে তিনটি বিকল্প খোলা আছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিতে হবে। অর্থনৈতিক সমস্যা যদি কাটতে শুরু করে, তখন এই বিকল্প বেছে নেওয়া ভালো হবে।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সামনে দ্বিতীয় বিকল্প হলো, নিজের নীতি পরিবর্তন করা। অবশ্য চীনা নেতারা নীতি পরিবর্তনে রাজি হন না; কারণ এতে নিজেদের অসচ্ছলতার আভাস ফুটে ওঠে, যা চীনের দুর্বলতাকে সবার সামনে ফাঁস করে দেবে। তাদের আশঙ্কা, নীতি পরিবর্তনের দিকে গেলে উদার অর্থনীতিগুলো চীনকে তার অর্থনীতি সংস্কারে চাপ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
তৃতীয় বিকল্প হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে আরও বেশি আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরা। চীন ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করছে। তার সামরিক বাহিনীও আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চীন পশ্চিমের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারে।
এর মধ্যে চীন কোনটিকে বেছে নেবে তার ওপর দেশটির অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● রিচার্ড এন হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট