স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রমের চারটি আবর্তন শেষ হয়েছে। ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে পঞ্চম আবর্তনের কাজ। কোনো দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমকে ‘তৈরি করা’ বলা যেতে পারে। পরেরগুলো ‘পরিমার্জন’ হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরে ঢিমেতালে চলা পরিমার্জন প্রক্রিয়াধীন শিক্ষাক্রমকে অনেকেই ‘নতুন’ নামের তকমা পরিয়েছেন। দেশের সব আবর্তনের শিক্ষাক্রমেই শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ আছে।
অথচ এবারের শিক্ষাক্রমে কিছু উদ্দেশ্যকে নতুনভাবে সংযোজনের দাবি করে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং টিভি আলোচনায় ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে অবিরাম ঢোলক বাজানো হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে এ অনুপযোগী শিক্ষাক্রমের আংশিক বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। একজন শিক্ষাগবেষক হিসেবে আমি শুরু থেকেই এ শিক্ষাক্রমের অসারতা সম্পর্কে লিখে আসছি। কিন্তু কেউই কর্ণপাত করেননি। শেষ পর্যন্ত গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগের (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২) শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। এই নিবন্ধে আমি এ সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা ও মতামত তুলে ধরছি।
আশু কর্তব্য হচ্ছে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি পরিমার্জনাধীন ও আংশিক বাস্তবায়নাধীন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে শিক্ষক-অভিভাবক এবং কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলন দেখেই হয়তো আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। এই মুহূর্তে অবশ্য এটাই করণীয়। কিন্তু ১২-১৩ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। কেন হতে পারে না? এর কারণ ত্রিবিধ।
১.জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে ১০-১২ বছরের মধ্যে/ব্যবধানে শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা হয়। বাংলাদেশ কোনোভাবেই শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।
২. ২০১১-১২ সালে যখন শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়, তখনো ২০৩০ সালকে লক্ষ্য করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়নি। ২০১৫ সালে গৃহীত এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাজ ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ বাস্তবায়নের প্রধান কৌশল অন্তর্ভুক্তি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ অর্জনের উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন জরুরি হয়ে আছে সেই ২০১৬ সালেই।
৩. একসময় শিক্ষাক্রম ছিল শিক্ষার বিষয়বস্তুভিত্তিক। এরপর ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলির শ্রেণিবিন্যাস প্রকাশিত হলে ১৯৬০–এর দশক থেকে শিক্ষাক্রম হয় উদ্দেশ্যভিত্তিক। ১৯৮০-৯০–এর দশকে, বিশেষত কোবের ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’ এবং জে ডেলরের ‘লার্নিং দ্য ট্রেজার উইদিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন (১৯৯৬) প্রকাশের পর থেকে ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যের তিন প্রধান ক্ষেত্রকে একত্রে একটি ককটেলের মতো বানিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলোর নাম দেওয়া হলো যোগ্যতা। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকেই সারা বিশ্বে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এখন সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই যোগ্যতাভিত্তিক করতে হবে।
উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের যথোপযুক্ত পরিমার্জন আবশ্যিক। তেমন পরিমার্জনের ভিত্তিতে ভালো মানের পাঠ্যপুস্তক রচনা করে আগামী দুই বছরের মধ্যে সেসব পাঠ্যপুস্তক প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ওপরের শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনায় শিক্ষাক্রমের যথাযথ পরিমার্জন প্রক্রিয়া যেভাবে হওয়া উচিত তা এখন তুলে ধরছি।
কোনো দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার নীলনকশা। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করতে হয় একসঙ্গে। তাতে পুরো জিনিসটা একসঙ্গে চিন্তা করা যায়, প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তুর উল্লম্ব এবং পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের মান যথার্থ করা যায়। এভাবে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় ক্রমান্বয়ে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর দিকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ একসঙ্গে পরিমার্জন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে না করে (সম্ভবত সরকার পরিবর্তনের ভয়ে) একসঙ্গে করে ফেলা হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ নামে যা বাস্তবায়নের (অপ) চেষ্টা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত কাঁচা হাতে তৈরি। তারা পুরো শিক্ষাক্রম একসঙ্গে পরিমার্জন করেনি। পিসমিল প্রক্রিয়ায় প্রথমে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাক্রম আধাখেঁচড়া পরিমার্জন করে অনুপযুক্ত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করিয়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন।
শেষ কথা, জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২তে ফিরে গিয়ে এবার সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের টেন্ডার করার ফাঁকে ফাঁকে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়ে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কমিটি গঠন করা হোক। ব্যক্তির নাম বলা হয়তো ঠিক হবে না। তবু বলি, বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে জ্ঞানী, পারদর্শী ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. মনজুর আহমেদের নেতৃত্বে ওই কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
কমিটির অন্যতম সদস্য হতে পারেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২–এর পরামর্শক ড. মো. ছিদ্দিকুর রহমান এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক সালেহ মতিন। দেখে-শুনে কিছু মধ্যবয়সী ও তরুণ শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ রাখা যায় কোর কমিটিতে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা হতে পারেন বিভিন্ন বিষয় কমিটির সদস্য।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)।