জাপানের হিরোশিমা নগরে ১৯-২১ মে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পশ্চিমা সাত শক্তির রাজনৈতিক জোট জি-৭-এর ৪৯তম সম্মেলন। ৭৮ বছর আগে পারমাণবিক বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া যে হিরোশিমার স্মৃতি এখনও বিশ্ব বহন করছে, সেই শহরের শহীদদের স্মৃতিস্মারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে উন্নত বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির নায়কেরা শান্তির বদলে যুদ্ধকেই প্রাধান্য দিলেন জি-৭ সম্মেলনে। ইউক্রেন পেল সাড়ে ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা, সেই সঙ্গে যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ প্রতিশ্রুতি।
এই দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলারে নামাল যা আগে ছিল ১২ ডলার।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে তাপপ্রবাহ, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা পরিবেশগত প্রতিকূলতার সামনে মানবজাতির নাজেহাল অবস্থা। আবার সেই সঙ্গে রয়েছে পৃথিবীজুড়ে চলমান নানা সংঘর্ষ ও শরণার্থী সমস্যা। পৃথিবীর এমন একটা নাজুক সময়ে আবার যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানি ও খাদ্যসংকট। এমন অবস্থায় এক হয়ে মানবতার লক্ষ্যে কাজ করার কথা ছিল সব পক্ষের। কিন্তু চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অর্থনৈতিক যুদ্ধের ফলে মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়ে ভীত ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে।
তাই হিরোশিমা নগরে জি-৭-এর মতো সম্মেলন থেকেই শান্তির বার্তা প্রত্যাশা করবে মানুষ। কিন্তু সেখানে বাজল যুদ্ধের বাজনা। এবারের সম্মেলনজুড়ে ছিল রাশিয়া ও চীনকে প্রতিহত করার আহ্বান, প্রতিশ্রুতি আর সংকল্প। অর্থাৎ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বে যুদ্ধ চলবে। ‘ঠান্ডা লড়াই ২.০’ হিসেবে অনেকেই এই সময়টাকে ভাবছেন যা এখন ‘গরম লড়াইতে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু জি-৭-এর বাইরের বিশ্ব কি চায় এই যুদ্ধ প্রসারিত হোক!
দুই বছর ধরে চলমান মহামারির ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ক্ষমতাবান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে গেল। যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছে না বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি চীন কেন তাকে ছাপিয়ে প্রথম অবস্থানে চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল রাশিয়ার দ্বারপ্রান্তে ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত করতে। তাতে রাশিয়ার কেন খেপে গিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে হবে!
যদিও ২০০৭ সাল থেকেই চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছিল। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার হঠাৎ করেই ঘোষণা দিল যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি নাকি ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই শুরু হলো চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প সরকারের ‘ট্যারিফ যুদ্ধ’।
বাইডেন সরকার দেশের জনগণের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে এক ধাপ এগিয়ে শুরু করল ‘মাইক্রো চিপ যুদ্ধ’। এসব একের পর এক বাধা মোকাবিলা করতে চীন তার বাজার সম্ভাবনা বাড়াতে শুরু করল অন্যান্য অঞ্চলে। চীনের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে।
মূলত সমুদ্রপথেই সিংহভাগ বাণিজ্যিক পণ্য যাতায়াত হয়। তাই চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর—যেসব পথে চীনের বাণিজ্য হয়, সেখানে শক্তভাবে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসারিত হলেও সামাজিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে চীন পিছিয়ে আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, চীন আমেরিকান প্রযুক্তি ব্যবহার করেই উন্নতি করেছে। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বিশ্বশান্তির পথে বড় হুমকি হিসেবে দেখছে।
৯ মে রাশিয়ার বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে মাত্র একটি সোভিয়েত টি-৩৪ যুদ্ধ ট্যাংক প্রদর্শন করে রাশিয়া পশ্চিম পক্ষের কাছে হাসির পাত্র হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়া তার সব শক্তি দিয়ে ইউক্রেনকে প্রতিহত করছে। রাশিয়ার এমন দুর্বল সময়ে জি-৭ জোটের কাছ থেকে শান্তির বার্তা আসতে পারত।
কিন্তু বাইডেন সরকার এই যুদ্ধে রাশিয়াকে এমনভাবে হারাতে চান যেন তারা আর কখনো কোনো দেশে হামলা চালাতে না পারে। অথচ ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দিয়ে রাশিয়াকে কেবলই চীনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এখন ১৯০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। চীনের নিজস্ব আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন সিয়াইপিএস মাধ্যমে চলে বাণিজ্য।
চীনের সামনেও রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। ভারত সাগরের সব দেশকে জোট বেঁধে চীনের ক্ষমতার সঙ্গে ভারসাম্য তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে। ১২-১৩ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ষষ্ঠ ভারত মহাসাগর সম্মেলন যেখানে ২৫টির বেশি দেশের মন্ত্রী, কূটনীতিক, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও নীতিনির্ধারকদের সমাগম হয়। সম্মেলনে বারবার প্রশ্ন এসেছে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির লক্ষ্য নিয়ে।
ইউক্রেন যুদ্ধে যখন রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে, এমন সময়ে ইউক্রেন ব্যাপক সামরিক সাহায্য পেল। এদিকে চীনের বিরুদ্ধেও একই সময়ে শুরু হলো বাণিজ্যযুদ্ধ। শত্রুর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার এখনই মোক্ষম সময়। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া ও চীন এক হয়ে কাজ করবে। দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীনকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৫০০ সামরিক বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের মহড়া করেছে উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে চীনের সীমানা নিয়ে বিরোধ আছে। ভারত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখেই তাদের বিরোধগুলোর মীমাংসা করে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চায়। ইরান থেকে শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মরিশাস, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনামসহ ভারত মহাসাগরবর্তী সব কটি দেশই শান্তির পথে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতিরে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক সমস্যাগুলো সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে চায়।
চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন দিয়ে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি নতুন মোড় নিচ্ছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদকে নিমন্ত্রণ করা হয় ১৯ মে জেদ্দায় আয়োজিত আরব লিগ সম্মেলনে। তিনি তাঁর বক্তব্যে একটি পরস্পর নির্ভরশীল, উন্নয়নশীল ও বিদেশি হস্তক্ষেপমুক্ত আরব লিগ গঠনের আশা প্রকাশ করেন, যেখানে আর যুদ্ধ ও ধ্বংস থাকবে না। যদিও বেশ কিছু দেশ এই সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাশারের কারণে যোগ দেয়নি।
সব আঞ্চলিক জোট শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে যুদ্ধের ওপরে। যুদ্ধরত দেশগুলো এখন শান্তির পথে হাঁটতে চাইছে। পূর্বের দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পশ্চিমের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, আর পশ্চিমের সমাজ পূর্বের উৎপাদনের ওপর। পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে তা এমনিতেই ন্যায্য না।
এখানে সম্পদের অসম বণ্টন থেকে শুরু করে, দারিদ্র্য, দাসত্ব, বাল্যবিবাহ, নারী, শিশু ও মাদক পাচারের মতো নানা সমস্যা এখনই আছে। ‘যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান’ নীতি ছাড়াও নানা উপায় নিশ্চয় আছে মানবজাতির এই সর্বাত্মক ধ্বংস রোধ করতে। ন্যাটো জোট যেভাবে রাশিয়া ও চীনকে বিশ্বশান্তির পথে হুমকি হিসেবে দেখছে, তাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় হয়তো এই শঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয়ে যাবে যদি আর কোনো পথ খোলা না হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে যখন রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে, এমন সময়ে ইউক্রেন ব্যাপক সামরিক সাহায্য পেল। এদিকে চীনের বিরুদ্ধেও একই সময়ে শুরু হলো বাণিজ্যযুদ্ধ। শত্রুর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার এখনই মোক্ষম সময়। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া ও চীন এক হয়ে কাজ করবে। দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীনকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৫০০ সামরিক বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের মহড়া করেছে উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে।
ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়াও ভারী ভারী সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় চীনের ‘বাড়ির সামনেই’ সংঘর্ষ শুরু হতে যাচ্ছে। তাইওয়ান সমস্যা বাষ্পায়িত হয়ে চলছে, এখন কেবলই চীনের ধৈর্য পরীক্ষার পালা। চীন যদি রাশিয়ার স্বার্থে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ায় তাহলে রাশিয়া কি তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে? যে পারমাণবিক বোমা হিরোশিমাকে ক্ষতবিক্ষত করে বিশ্বকে হতবাক করেছে, বিশ্বে এমন হাজার হাজার বোমা আছে বেশ কয়েকটা দেশের কাছে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। বিশ্বের মানুষ ক্ষমতা-অন্ধ এই রাষ্ট্রনায়কদের স্বার্থে জিম্মি।
বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি আশঙ্কা করেন, বিশ্ব হয়তো এবার আর পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি থেকে রেহাই পাবে না।
বিজ্ঞানের এই অসাধারণ উদ্ভাবনের যুগে যুদ্ধ কাম্য নয়। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যে ধ্বংস যন্ত্র তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে, তা দিয়ে পুরো মানবজাতিকে ভালো খাবার ও জীবন দেওয়া সম্ভব। অথচ মানুষের সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে মানুষের সম্পদ ধ্বংসের জন্য।
যুদ্ধে যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন, কোনো পক্ষই ক্ষতি এড়াতে পারবে না। এক পারমাণবিক বোমায় হিরোশিমা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক বোমা এই পৃথিবীকে গুঁড়া করে দিতে যথেষ্ট। আমরা কেন এমন ভয়াবহ পরিণতির পথে হাঁটছি!
আইরিন খান গবেষক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক