ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট সংগঠন ব্রিকস-এর নেতারা ২২ আগস্ট (আজ মঙ্গলবার) জোহানেসবার্গে যখন দুই দিনের সম্মেলনে যোগ দেবেন, তখন ওয়াশিংটনের নীতি নির্ধারকেরা সন্দেহাতীতভাবে ওই নেতাদের কথা খুব মন দিয়ে শুনবেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের নানা উদ্যোগকে ব্রিকস যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কূটনৈতিক দিক থেকে সেই নিষেধাজ্ঞাকে ব্রিকস প্রচ্ছন্নভাবে খাটো করেছে। ডলারকে দুর্বল করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রার মর্যাদা থেকে তাকে নামিয়ে আনার চেষ্টাও ব্রিকস দেশগুলো করে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
ব্রিকসের সদস্যসংখ্যা ২৩-এ উন্নীত করার পরিকল্পনার কথা রয়েছে। সদস্য হতে আগ্রহী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ইরান, কিউবা ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশও আছে। অর্থাৎ ব্রিকস দিন দিন যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ওয়াশিংটন কী করবে এবং ব্রিকসের কাজকর্মের প্রতিক্রিয়া জানাবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টাফ্টস ইউনিভার্সিটিতে আমাদের গবেষণা দল উদীয়মান শক্তিদের জোটগুলো নিয়ে গবেষণা করে আসছে এবং তারা ব্রিকসের বিবর্তন প্রক্রিয়া ও তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে মূল্যায়ন করেছে। গবেষণায় আমরা যা পেয়েছি, তা হলো চীনা আধিপত্যের অধীনে থাকা ব্রিকস নামের এই গ্রুপ মার্কিন স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করে থাকে বলে সাধারণভাবে যা বলা হয়ে থাকে, তা আসলে ঠিক নয়।
বরং ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো অভিন্ন উন্নয়ন স্বার্থ ও বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার অন্বেষণে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে যেখানে কোনো একক শক্তির আধিপত্য নেই। তবে এটি সত্য যে ব্রিকসে জড়ো হওয়া দেশগুলো একটি শক্তিশালী গ্রুপে পরিণত হয়েছে, যা এখন ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসছে। এ কারণে ব্রিকসকে বৃহৎ নীতি শক্তি হিসেবে গণনা না করা এবং উদীয়মান শক্তি হিসেবে তাকে উপেক্ষা করা আর যুক্তরাষ্ট্রের সাধ্যের মধ্যে নেই।
২০০৮ সালে, অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেওয়ার আগে (দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেয় ২০১০ সালে) ব্রাজিলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেলসো আমোরিন বলেছিলেন, বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিকসের অধিকতর গণতন্ত্র আনার কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। এটি করতে হলে নীতি নির্ধারক পর্ষদে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের পুনর্বিন্যাস বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন শক্তিকে দুর্বল করতে পারে—ওয়াশিংটন যাতে এমনটি না ভাবে, সে জন্য সংগঠনটি তখন মার্কিনবিরোধী বক্তব্য দেওয়া থেকে নিজেকে সংযত রেখেছিল।
২০০৯ সালের সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন নিশ্চিত করে বলেছিলেন, তাদের এই সংগঠনের লক্ষ্য কোনোভাবেই মার্কিন স্বার্থের বিরোধিতা করা নয়। চীন ও রাশিয়া ডলারের আধিপত্যকে খর্ব করার জন্য সংগঠনটিকে ব্যবহার করছে বলে যেসব অভিযোগ উঠেছিল, তা–ও তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আজকে ব্রিকসের আওতায় বিশ্বের ৪১ শতাংশ মানুষ, ৩১.৫ শতাংশ বৈশ্বিক জিডিপি এবং ১৬ শতাংশ বৈশ্বিক বাণিজ্য। এই অবস্থায় যদি সদস্যরাষ্ট্রগুলো এক হয়, তাহলে তারা বৈশ্বিক দর-কষাকষির একটি বৃহৎ শক্তি হয়ে দাঁড়াবে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে তাঁরা ঘনিষ্ঠ হচ্ছেও।
ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যখন রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আটকে ফেলতে চাইছে, সে মুহূর্তে মস্কোর ব্রিকস অংশীদারেরা তাকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার জোরালো আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিল, ভারত ও চীন মস্কোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক গুণ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে এই সব দেশ এখন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাজার হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে যে ঐক্যের শক্তি গড়ে উঠেছে, তা বাইডেন প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক স্বার্থ ব্রিকসের কারণে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা হিসাব–নিকাশের মধ্যে আনা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া ব্রিকসের সম্প্রসারণও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ আলজেরিয়া ও মিসরের মতো দেশগুলোও এখন ব্রিকসে যোগ দিতে চাইছে।
সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘ব্রিকস নীতি’ তৈরি করা উচিত, যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন করে কল্পনা করতে সাহায্য করতে পারে। সেই ব্রিকস নীতি নিশ্চিত করতে পারবে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর কোনো একক দেশের খবরদারির বিশ্বে নয়, বরং একটি বহুমুখী বিশ্বে অবস্থান করছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
● মিহেলা পাপা টাফ্টস ইউনিভার্সিটির দ্য ফ্লেচার স্কুলের একজন সিনিয়র ফেলো;
● ফ্র্যাঙ্ক ও’ ডোনেল বোস্টন কলেজের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ প্রোগ্রামের সহকারী প্রভাষক এবং
● জেন হ্যান স্যাক্রেড হার্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক